খোলা বাজার২৪, শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ : সাধারণত কোনো শিশুর জন্মদানে দুজন মানুষের ভূমিকা থাকে। আর তারা হলো শিশুটির বাবা ও মা। কিন্তু একজন শিশুর জন্মদানে যদি তিনজন মানুষের ভূমিকা থাকে? কথাটি শুনে আপনার চোখ কপালে উঠলেও সম্প্রতি বিশ্ব এমনই এক বিষ্ময়কর ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন।
কারণ বিশ্বে প্রথমবারের মতো নতুন উপায়ে বিতর্কিত ‘৩ জনক’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি শিশুর জন্ম দেয়া হয়েছে। জন্ম নেয়া ছেলে শিশুটি নতুন উপায়ে বিতর্কিত প্রযুক্তিতে জন্ম নেয়া প্রথম শিশু। এই শিশুর শরীরে তার বাবা-মা ছাড়াও আরো একজনের ডিএনএ রয়েছে। এটা করা হয়েছে তার মায়ের শরীর থেকে যেন জেনেটিক ত্রুটি গুলো তার শরীরে ঢুকতে না পারে সে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য।
এ প্রসঙ্গে লন্ডনের কিংস কলেজের গবেষক ডাসকো ইলিচ, বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নিউ সায়েন্টিস্টকে বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য খুবই বড় একটি সুখবর। এটি চিকিৎসা শাস্ত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে।’
নতুন প্রযুক্তিকে গত বছর যুক্তরাজ্যে বৈধতা দেয়া হয়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিরল জেনেটিক ত্রুটি মায়েরাও আইভিএফ প্রক্রিয়ার সময় অন্য মহিলার সঙ্গে তার ত্রুটিপূর্ণ মাইটোকন্দ্রিয়াল ডিএনএ প্রতিস্থাপন করে সুস্থ সবল শিশু জন্ম দিতে সক্ষম হবেন।
এক্ষেত্রে মাইটোকন্দ্রিয়াল রোগে আক্রান্ত একজন মহিলার মায়ের ডিম্বাণু থেকে গুরুত্বপূর্ণ সব ডিএনএ এর সঙ্গে অন্য সুস্থ নারীর মাইটোকন্দ্রিয়াল ডিএনএ পিতার শুক্রাণু দিয়ে একসঙ্গে নিষিক্ত করা হয়। এবং একমাত্র এই উপায়েই ওই দম্পত্তি একটি সুস্থ সন্তান জন্মদানে সক্ষম হোন।
নতুন এই প্রযুক্তিটি মেক্সিকোতে মার্কিনভিত্তিক একটি চিকিৎসক দল কর্তৃক জর্ডানের এক মায়ের ওপর ব্যবহার করা হয়েছিল। ছেলেটির মা ‘লে সিন্ড্রোম’ নামক স্নায়ুতন্ত্রের এক মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিল যা মাইটোকন্দ্রিয়াল ডিএনএ এর মাধ্যমে শিশুটির শরীরেও প্রবাহিত হতে পারত।
আমাদের মাইটোকনড্রিয়ায় থাকা মাইটোকন্দ্রিয়াল ডিএনএ, যার সম্পর্কে আমরা বিদ্যালয়ের জীববিদ্যা বই থেকে জেনেছি, এটিকে কোষের ‘পাওয়ার হাউজ’ বলা হয়। এটি কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত অন্যান্য নিয়মিত ডিএনএ এর মতো নয়, কারণ এটি শুধুমাত্র নারী দেহ থেকেই প্রববাহিত হয়।
‘৩ জনক’ প্রযুক্তি ব্যবহারের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। ইউ অনুমোদিত পদ্ধতিটিকে প্রোনুক্লিয়ার ট্রান্সফার বলা হয় এবং এটিতে মায়ের ডিম্বাণু এবং দাতার ডিম্বাণুর সঙ্গে বাবার শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত করা হয়।
আগে এই দুই নিষিক্ত ডিম্বাণু একটি ভ্রূণে বিভক্ত করে গবেষকরা মায়ের নিউক্লিয়াসের সঙ্গে দাতা ডিম্বাণু এর নিউক্লিয়াস প্রতিস্থাপন করেন। কিন্তু এই শিশুটির বাবা-মা মুসলিম এবং এই নিষিক্ত কোষ ধ্বংস করার সঙ্গে নৈতিক বিষয় ছিল। সুতরাং তাদের ক্ষেত্রে পারমাণবিক ট্রান্সফার নামক একটি ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যা প্রায় একই ভাবে কাজ করে, কিন্তু ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার পূর্বেই নিউক্লিয়াস স্থানান্তর করা হয়।
এই প্রযুক্তিতে মোট পাঁচটি ভ্রূণ সৃষ্টি করা হয়েছিল কিন্তু শুধুমাত্র একটি ভ্রূণ সুস্থভাবে বেড়ে উঠেছিল এবং সেটিই ওই মায়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল। শিশুটি এখন পাঁচ মাস বয়সী এবং তার মধ্যে এখনো পর্যন্ত ‘লে সিন্ড্রোম’ এর কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
কিন্তু এখনো পর্যন্ত অনেক বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতি নিয়ে উদ্বিগ্ন যে এই পদ্ধতির ফলে ভবিষ্যতে শিশুর স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এখনো পর্যন্ত ছেলেটির মাইটোকনড্রিয়া ১ শতাংশেরও কম ‘লে সিন্ড্রোম’ বহন করছে যা তার বৃদ্ধিকে মোটেও প্রভাবিত করবে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু এই গবেষণায় জড়িত না থাকা নেদারল্যান্ডের মাস্ট্রিক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ট স্মিথ, নিউ সায়েন্টিস্ট জানানকে, শিশুটিকে ঘনিষ্ঠভাবে নিরীক্ষণ করা প্রয়োজন এবং এই প্রযুক্তিটিকে ‘নিরাপদ’ হিসেবে বিবেচনা করার পূর্বে এটিকে আরো সূক্ষভাবে পরীক্ষা করা উচিত।
তিনি বলেন, আমাদের আরো কিছু শিশু জন্মানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে এবং সাবধানতার সঙ্গে তা বিচার করতে করতে হবে।
তিনজন মানুষের শরীর থেকে ডিএনএ নিয়ে শিশুর জন্মদান এই প্রথম নয়। নব্বইয়ের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনজনের ডিএনএ দিয়ে শিশুর জন্ম দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেসব শিশুদের মধ্যে কিছু জিনগত রোগ বিকাশ লাভ করেছিল, যে কারণে অনেক বিজ্ঞানীরা এখনো নতুন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক।
সময়ই বলে দেবে যে মাইটোকন্দ্রিয়াল রোগে আক্রান্ত নারীদের নিরাপদে সন্তান জন্মদানে এই প্রযুক্তি কোনো সাহায্য করতে পারবে কিনা। কিন্তু প্রথম সুস্থ সন্তানের জন্ম দেয়ায় এটা অবশ্যম্ভাবী যে প্রযুক্তিটি পুণরায় ব্যবহার করা হতে যাচ্ছে।