খোলা বাজার২৪,শনিবার,০৮ অক্টোবর, ২০১৬: দেশে হঠাৎ বিদেশি নাগরিকদের বেতন-ভাতা ব্যয় বেড়ে চলছে। দেশের যেকোনো সময়ের তুলনায় এ বেতন-ভাতা ব্যয় বেড়ে গেছে। আর এ সুবাদে দেশের সেবামূলক খাতে ঘাটতি বেড়ে গেছে। বাড়ছে পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি ও বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয়। চলতি হিসাবের ভারসাম্য উদ্বৃত্ত রাখতে একমাত্র সহায়ক ভূমিকা পালন করে রেমিট্যান্স। এ রেমিট্যান্সও তিন মাস ধরে অব্যাহতভাবে কমে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন নীতি-নির্ধারকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, রেমিট্যান্স অব্যাহতভাবে কমে যাওয়ায় চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে দেশের নিয়মিত লেনদেনও ঋণনির্ভর হয়ে পড়বে। এটা হলে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে ছেদ পড়বে বলে তারা মনে করছেন। : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা জানান, দেশের চলতি হিসাবের মধ্যে রয়েছে চারটি উপখাত। এ চার খাতের মধ্যে একমাত্র রেমিট্যান্স বাদে তিনটিতেই ঘাটতি দিন দিন বাড়ছে। এর মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে সেবা খাতের ঘাটতি। : দেশে হঠাৎ বিদেশি নাগরিকদের বেতন-ভাতা ব্যয় বেড়ে গেছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে অর্থাৎ জুলাইতে সেবা খাতের ঘাটতি হয়েছে ২৭ কোটি ডলার, যা আগের বছরের প্রথম মাসে ছিল ১৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ প্রথম মাসেই সেবা খাতের ঘাটতি বেড়েছে ৮০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশে হঠাৎ করে বিদেশি নাগরিকদের কর্মকান্ড বেড়ে গেছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতসহ বিভিন্ন সেক্টরে প্রতিবেশী দেশসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা চাকরিতে ঢুুকে পড়ছেন। ফলে বিদেশি নাগরিকদের পেছনে বেতন-ভাতা ব্যয় বেড়ে গেছে। আর এটিই উদ্বেগের কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত জুলাই মাসে বিদেশি নাগরিকদের পেছনে বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় হয়েছে ৫০ কোটি ডলার, বিপরীতে বাংলাদেশ সেবা খাত থেকে আয় করেছে ২৩ কোটি ডলার। ফলে সেবা খাতের ঘাটতি হয়েছে ২৭ কোটি ডলার। এ ঘাটতি আগের বছরে ছিল মাত্র ১৫ কোটি ডলার। বিশ্লেষকরা জানান, প্রতি বছর দেশের শ্রমবাজারে নতুন ২০ থেকে ২৫ লাখ শ্রমিক আসছে। কিন্তু বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অবকাঠামো সুবিধার অভাব এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় বর্ধিত হারে বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে কর্মক্ষম শ্রমিকের সংখ্যা বাড়লেও কর্মক্ষেত্রের সুযোগ বাড়ছে না। এর বিপরীতে স্থানীয় শিল্পে বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা বাড়লে বেকারত্বের হার আরো বেড়ে যাবে। : এদিকে কাক্সিক্ষত হারে রফতানি আয় না বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে গেছে। যেমন জুলাইতে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে প্রায় ২৪ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল প্রায় ৫ কোটি ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়ে যাচ্ছে। যেমন গত জুলাই মাসে সুদ পরিশোধ হয়েছে ২১ কোটি ২০ লাখ ডলার, এর ফলে জুলাইয়ে প্রাথমিক আয়ের ঘাটতি হয়েছে ২১ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৯ কোটি ডলার। : চলতি হিসাবের ভারসাম্য উদ্বৃত্ত রাখার একমাত্র উপায় ছিল রেমিট্যান্স প্রবাহ। কিন্তু এ রেমিট্যান্স প্রবাহও অব্যাহতভাবে কমে যাওয়ার কারণে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম মাসে অর্থাৎ জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১০০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৩৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম মাসে রেমিট্যান্স কম এসেছে প্রায় ২৮ শতাংশ। আগস্টেও আগের বছরের তুলনায় রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যায়। গত আগস্টে রেমিট্যান্স এসেছিল ১১৮ কোটি ৩৬ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১২০ কোটি ডলার। শতকরা হিসাবে ১ দশমিক ৩৭ ভাগ কম। একই ধারাবাহিকতায় গত সেপ্টেম্বরেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। গত মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১০৪ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে এসেছিল প্রায় ১৩৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসে রেমিট্যান্স কমে গেছে প্রায় ২৩ শতাংশ। অব্যাহতভাবে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রতিবেশী দেশসহ প্রায় প্রতিটি দেশে ডলারের বিপরীতে তাদের স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে। কিন্তু ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। ডলারের মানে কোনো পরিবর্তন না হওয়া রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি ইউরোপীয় দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক বেকার রয়েছেন। ফলে ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য থেকে তো আগে থেকেই রেমিট্যান্স কমে গেছে। সব মিলে রেমিট্যান্স প্রবাহে ঋণাত্মক প্রভাব পড়েছে। : রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে ব্যাংকাররা জানান, এ কথা স্বীকার করতেই হবে, আগের মতো আর বাংলাদেশ থেকে বিদেশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক যাচ্ছে না। এর প্রভাবে গত চার-পাঁচ বছর আগে যে হারে রেমিট্যান্স আসছিল ওই হারে এখন আর আসছে না, বরং দিন দিন তা কমে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ হচ্ছে না। এ কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামালসহ কাক্সিক্ষত হারে পণ্য আমদানি হচ্ছে না। এর প্রভাব মুদ্রার বিনিময় হারের ওপর পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের চাহিদা নেই। ব্যাংকগুলো বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স এনে দেশে সুবিধাভোগীদের নগদে পরিশোধ করছে। কিন্তু বাজারে বিক্রি করতে না পারায় ও ডলার কাজে লাগাতে না পারায় বাধ্য হয়ে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিক্রি করছে। : রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হওয়ার আশঙ্কা। বিষয়টি চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা জানান, যে হারে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বেড়ে যাবে। ইতিমধ্যে এর প্রভাব পড়েছে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে। যেমন গত বছরের জুলাইয়ে চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত ছিল ১০২ কোটি ডলার, সেখানে চলতি বছরের জুলাইয়ে তা কমে এসেছে ৩২ কোটি ডলারে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে তা ঋণাত্মক হয়ে যাবে। আর ঋণাত্মক হয়ে গেলে শুধু নিয়মিত লেনদেনই ঋণনির্ভর হবে না, বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহও কমে যাবে; এতে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অপরদিকে চলতি হিসাবে ঘাটতি হলে তা রিজার্ভে চাপ বাড়ানোর পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির ওপরও প্রভাব ফেলবে।