খােলা বাজার২৪। শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭: বাজারে নতুন মুড়িকাটা পিঁয়াজ উঠলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির ঝাঁজ এখনো কমেনি। গত বছর ডিসেম্বরে প্রতি কেজি পিঁয়াজ ২০ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হলেও গতকাল শুক্রবার রাজধানীর খুচরা বাজারগুলোতে প্রতি কেজি দেশী পিঁয়াজ ১০০ থেকে ১২০ টাকা ও আমদানিকৃত পিঁয়াজ ৭০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবে এই দর তুলে ধরা হয়েছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এভাবে লাগামহীনভাবে পিঁয়াজের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত ১৫ বছরের ব্যবধানে দেশে পিঁয়াজের উত্পাদন বাড়লেও তা চাহিদার তুলনায় কম। ফলে প্রতি বছরই একটি নির্দিষ্ট পরিমান পিঁয়াজ আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু এ বছর দেশে বন্যা ও টানা বৃষ্টির ফলে পিঁয়াজ নষ্ট হওয়ায় ঘাটতির পরিমাণ বেশি হয়েছে। এছাড়া ভারত পিঁয়াজের রপ্তানি মূল্য বৃদ্ধি করায় দেশে নিত্যপ্রয়াজনীয় এ পণ্যটির বাজারে রীতিমতো ‘আগুন’ লেগেছে। গত ২৩ নভেম্বরের হঠাত্ করেই পিঁয়াজের রপ্তানি মূল্য এক লাফে টন প্রতি ৩৫২ ডলার বাড়িয়ে ৮৫২ ডলার নির্ধারণ করে ভারত। এরপর থেকেই পিঁয়াজের বাজার লাগামহীন।
কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে পণ্যটি নিয়ে প্রায় প্রতি বছরই ঘুরেফিরে সংকটে পড়তে হয় সেই পিঁয়াজ নিয়ে গবেষনায় বাড়তি কোন বরাদ্দ নেই। অথচ উত্পাদন বাড়াতে পিঁয়াজ নিয়ে গবেষনায় জোর দেয়া সময়ের দাবি। সেইসাথে উত্পাদন বাড়াতে অ্যাকশন প্লান নিয়ে এগুতে হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে বছরে ২২ থেকে ২৪ লাখ টন পিঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে ১৮ লাখ ৬৬ হাজার টন পিঁয়াজ উত্পাদিত হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ১ লাখ ৩১ হাজার টন বেশি। বিবিএস’র তথ্যমতে, দেশে প্রতি বছরই পিঁয়াজের উত্পাদন বাড়ছে।
এর আগে ২০০০-২০০১ অর্থবছরে দেশে পিঁয়াজের উত্পাদন হয় মাত্র ১ লাখ ২৬ হাজার টন। ২০০৫-২০০৬ অর্থ বছরে উত্পাদন হয় ৫ লাখ ৮৯ হাজার টন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে পিঁয়াজের উত্পাদন বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৮ লাখ ৭২ হাজার টন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে উত্পাদন ১৩ লাখ ৭১ হাজার টন। ২০১৬-১৭ অর্ধ বছরে দেশে ১৮ লাখ ৬৬ হাজার টন। তবে প্রতি বছর উত্পাদন বাড়লেও তা চাহিদার তুলনায় কম।
কৃষি বিজ্ঞানীদের মনে করেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং মাঠ থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত উত্পাদনের বড় একটি অংশের অপচয়ের কারণে ঘাটতির পরিমাণ অনেক বেশি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে পিঁয়াজের চাহিদা ২২ থেকে ২৪ লাখ টন। বিবিএসের তথ্য মতে, দেশে ১৮ লাখ ৬৬ হাজার টন উত্পাদিত হয়। সে হিসাবে দেশে পিঁয়াজের ঘাটতি হওয়ার কথা ৪ থেকে ৬ লাখ টন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পিঁয়াজের উত্পাদনের এ তথ্য শেষ পর্যন্ত ঠিক থাকছে না। কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, মাঠ থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত উত্পাদনের ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ অপচয় হয়। জাতভেদে এ অপচয়ের পরিমাণ ৫০ শতাংশ পর্যন্তও হয়। পিঁয়াজ উত্তোলনের ১ মাস পরেই ২০ শতাংশ ওয়াটার লস (পানি হ্রাস) হয়। এভাবে প্রতিনিয়তই ওজন কমে। এ কারণে ১৮ লাখ ৬৬ হাজার টনের ৩৫ শতাংশ অপচয় হলে প্রকৃত উত্পাদন গিয়ে দাঁড়ায় ১২ লাখ টনে। সে হিসাবে ঘাটতি ১০ থেকে ১২ লাখ টন। যা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, আলোচ্য সময়ে দেশে ১০ লাখ ৪১ হাজার টন পিঁয়াজ আমদানি হয়েছে। অর্থাত্ দেশে পিঁয়াজের উত্পাদন বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ভারতে হেক্টর প্রতি পিঁয়াজের উত্পাদন ১৭ টন এবং মিয়ামনারে ১৫ টন। অথচ বাংলাদেশে হেক্টর প্রতি ফলন মাত্র ১০ লাখ টন। হেক্টর প্রতি ফলন বৃদ্ধি করে ৬০ শতাংশ উত্পাদন বাড়ানো সম্ভব বলে তারা মনে করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পিঁয়াজ গবেষনায় বাড়তি কোন বরাদ্দ নেই। অথচ প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার পিঁয়াজ আমদানি করা হয়। এছাড়া পিঁয়াজের ফলন কম হওয়ার পেছনে ভাল বীজ না থাকাকে দায়ী করেছেন বিজ্ঞানীরা। দেশে পিঁয়াজ বীজের চাহিদা ১৬ হাজার ১শ’ টন। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ২০১৫-১৬ বর্ষে মাত্র ১০৫ টন বীজ সরবরাহ করে। যা মোট চাহিদার দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। এছাড়া বেসরকারি কিছু কোম্পানিও বীজ সরবরাহ করে। যার পরিমাণও সামান্য। বাকি বীজ কৃষকরা নিজেরা ঘরে সংরক্ষণ করে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃষকদের সরবরাহ করা বীজ ততটা মান উপযোগী নয়। তাদের সংরক্ষণাগারও নেই। ফলে বীজের আর্দ্রতাও ঠিক থাকে না। থাকে না সঠিক মান। ফলে চাহিদা অনুযায়ী ফলন পাওয়া যায় না। যদি সরকারের বিভিন্ন সংস্থার চাহিদার বড় একটি অংশ বীজ সরবরাহ করতে পারে তবে ফলন আরো বাড়বে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে মসলা গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাসুদুল হক বলেন, পিঁয়াজের উত্পাদন বৃদ্ধিতে অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, পিঁয়াজের আবাদের অনেক ধরনের প্রযুক্তিও রয়েছে। কৃষকদের এ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। তিনি বলেন, ভালো বীজে ভাল ফসল। তাই পিঁয়াজের জন্য ভালো বীজের দিকে নজর দিতে হবে। ইত্তেফাক