খােলা বাজার২৪।বৃহস্পতিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৭: একটি মুসিলম দেশের নেতৃত্ব দেওয়া প্রথম নারী বেনজির ভুট্টো। রাওয়ালপিন্ডিতে ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বরে আত্মঘাতী হামলায় যিনি নিহত হয়েছিলেন।
আজ তার মৃত্যুর ১০ বছরেও উত্তর মেলেনি কে তাকে মেরেছিল। তাকে হত্যার দায়ে কেউ দোষী সাব্যস্ত পর্যন্ত হয়নি।
এক দশক পরে এসেও এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে জলঘোলা হচ্ছে পাকিস্তানে। তাকে হত্যার আদেশ কে দিয়েছিল বেরিয়ে আসছে না সে তথ্য। ধামচাপা পড়ে থাকছে প্রকৃত সত্য।
রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর নির্বাচনী সমাবেশ শেষে তার গাড়ি বহরের কাছে গিয়ে তাকে গুলি করে এবং আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায় বিলাল নামের এক কিশোর।
ওই সময় স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে এ হত্যার আদেশ পাকিস্তানের তালেবান জঙ্গিরা দিয়েছিল বলে খবর প্রকাশ পায়।
পাকিস্তানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর মেয়ে ছিলেন বেনজির ভুট্টো। জেনারেল জিয়া-উল হকের আমলে জুলফিকার আলিকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এরপর ১৯৯০-এর দশকে দুইবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন বেনজির। কিন্তু সেনাবাহিনী সবসময় তার বিরুদ্ধে লেগে থেকে দুর্নীতির অভিযোগে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ছাড়ে।
মৃত্যুর আগে তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন বেনজির। আততায়ীর হাতে তার মৃত্যুর খবরে পাকিস্তানে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। তার সমর্থকরা রাস্তায় নেমে আসে। পাকিস্তান-বিরোধী স্লোগানে মুখরিত হয় দেশ।
জেনারেল মুশাররফ ও টেলিফোনে হুমকি:
বেনজির ভুট্টো হত্যাকাণ্ডের সময় পাকিস্তানের ক্ষমতায় ছিলেন সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মুশাররফ। হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পর সেই মুশাররফ এখন বলছেন, ওই ঘটনায় পাকিস্তানের রাষ্ট্র-যন্ত্রের কোন অংশ জড়িত থাকতে পারে।
হত্যাকাণ্ডে তালেবান জঙ্গিদের সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্বৃত্তদের যোগসাজশ ছিল কিনা- জানতে চাইলে মুশাররফ বলেন, “সম্ভবত। থাকতে পারে। ধর্মীয় মত-পথ নিয়ে সমাজে মেরুকরণ আছে। হত্যাকাণ্ডে সমাজের ওই অংশের হাত থাকতে পারে।”
এ ধরনের কথা বলে সবাইকে অবাক করেছেন মুশাররফ। কারণ, সহিংস জিহাদি হামলার সঙ্গে রাষ্ট্রের জড়িত থাকার কথা পাকিস্তানের সামরিক নেতারা সাধারণত অস্বীকার করে থাকেন।
বেনজির হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো দুর্বৃত্ত অংশের জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ তার কাছে কিনা- জানতে চাইলে মুশাররফ বলেন, “আমার কাছে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে আমি মনে করি, আমার অনুমান খুবই সঠিক। পশ্চিমাদের দিকে ঝোঁক থাকা একজন নারীকে দুর্বৃত্তরা সন্দেহের চোখে দেখতেই পারে।”
বেনজির ভুট্টো হত্যা মামলায় মুশাররফ নিজেও অভিযুক্ত। তার বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যার ষড়যন্ত্র ও হত্যায় সহায়তা করার অভিযোগে মামলা আছে। বেনজির ভুট্টোর আইনজীবীরা বলেছেন, ২০০৭ সালে বেনজির স্বেচ্ছানির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসার তিন সপ্তাহ আগে ২৫ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে থাকা অবস্থায় তাকে ফোন করেছিলেন মুশাররফ।
বেনজির ভুট্টোর দীর্ঘদিনের সহযোগী মার্ক সায়গল ও সাংবাদিক রন সাস্কিন্ড উভয়েই বলেছেন, ফোন আসার সময় তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সায়গল বলেছেন, ফোনে কথা বলার পরপরই বেনজির তাদের বলেছিলেন, তিনি (মুশাররফ) আমাকে হুমকি দিয়েছেন। দেশে না ফিরতে বলেছেন। ফিরে না যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।”
সায়গল বিবিসি’কে বলেন, “মুশাররফ তাকে বলেছিলেন, দেশে ফিরলে তার যদি কিছু হয়ে যায় সেজন্য তিনি দায়ী থাকবেন না। তিনি আরো বলেছিলেন, বেনজিরের নিরাপত্তা নির্ভর করছে তার (মুশাররফ) সঙ্গে সম্পর্কের ওপর।”
তবে বেনজিরকে ফোন করার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন মুশাররফ। তাকে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগও প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। সম্প্রতি বিবিসি’কে তিনি বলেছেন, “এমন প্রশ্ন শুনলে আমার হাসি পায়। কেন আমি তাকে হত্যা করতে যাব?”
হত্যার ষড়যন্ত্র ও অভিযুক্ত জঙ্গিরা খালাস
দুবাইয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকায় মুশাররফের বিরুদ্ধে মামলা স্থগিত রয়েছে। তবে বেনজিরের ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো মুশাররফের বক্তব্য খারিজ করে দিয়েছেন।
বিলাওয়ালের দাবি, “আমার মাকে হত্যার পুরো ষড়যন্ত্র করেছেন মুশাররফ। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে তার নিরাপত্তা দুর্বল করে রেখেছিলেন যেন তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন এবং দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে যান।”
মুশারফের বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়া আটকে থাকার এ সময়ে বাকিদের মামলা থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে। বেনজির হত্যাকাণ্ডের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পাঁচজন সন্দেহভাজন তালেবান ও আল-কায়েদার পক্ষ থেকে স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছিল, তারা আত্মঘাতী হামলাকারী বিলালকে সহায়তা করেছে।
আটককৃতদের মধ্যে আরো দুজন হত্যা পরিকল্পনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছিল। হামলাকারীকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করার কথাও তারা স্বীকার করে।
এসব স্বীকারোক্তি তারা পরবর্তীতে প্রত্যাহার করে নিলেও অভিযুক্তদের ফোনালাপ এবং ঘটনার আগে তাদের অবস্থান যাচাই করে হত্যাকাণ্ড তাদের জড়িত থাকার আভাস পাওয়া গেছে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আদালতে কোনো কিছুই প্রমাণিত হয়নি। বিচারক বলেছেন, যে প্রক্রিয়ায় তথ্য-প্রমাণ জোগাড় এবং উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে অভিযুক্তদের খালাস দিতে হচ্ছে।
আপিলের নিষ্পত্তি না হওয়ায় অভিযুক্ত ৫ জন এখনো কারাগারে আছে।
বেনজির হত্যায় জারদারির ভূমিকা নিয়ে ধন্দ:
বেনজির নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়া জারদারির বিরুদ্ধেই তার স্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের গুঞ্জন শোনা গেছে।
কারণ, প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন- এমনটিই সবার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
কিন্তু জারদারি তার স্ত্রী বেনজিরকে হত্যায় জড়িত- এমন কোনও প্রমাণ কেউ দেখাতে পারেনি। জারদারি নিজেও এমন অভিযোগ জোরালভাবেই নাকচ করেছেন।
কিন্তু এ অভিযোগ নাকচ করলেও আরেকটি অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উঠেছে। আর তা হল প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা পাওয়ার পরও তিনি বেনজির হত্যাকাণ্ড যথাযথভাবে তদন্ত করতে পারেননি।
তদন্তকাজ সংশ্লিষ্ট গোপন নথিপত্রে দেখা গেছে, পুলিশের তদন্ত এতটাই দুর্বলভাবে এগিয়েছে যে, তাতে বলা যায় তারা কখনো দাগী আসামিদের খুঁজেই বের করতে চায়নি। কেবল নিচুস্তরের কিছু চক্রান্তকারীকে আটক করেই কাজ সারতে চেয়েছে।
তাছাড়া, তদন্তে সামরিক বাহিনী ছাড়াও জারদারির মন্ত্রীদের কাছ থেকে বাধা এসেছে বলে অভিযোগ আছে।
জারদারি হত্যাকাণ্ড তদন্তে জাতিসংঘ কমিশনের কাজ করার কথা বললেও তদন্ত যতই এগিয়েছে জাতিসংঘ টীমের আর দেখা মেলেনি।
হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে কয়েকজন নিহতের ঘটনা:
বেনজির হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে কয়েকজন নিহত হওয়ার ঘটনায় এটি পরিষ্কার যে, হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলেছে।
বিবিসি’র একটি তদন্তে দেখা গেছে, বেনজিরকে হত্যাকারী কিশোরকে সাহায্য করা দুইজন ২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারিতে একটি সামরিক চেকপয়েন্টে গুলিতে নিহত হয়। তারা এনকাউন্টারে মারা গেছে বলে বিবিসি’কে জানান জারদারি সরকারের ঊর্ধ্বতন এক সদস্য।
তালেবান-সমর্থিত হাক্কানি মাদ্রাসার দুই ছাত্র নাদির এবং নাসরাল্লাহ খান এবং ওই মাদ্রাসার অন্যান্য ছাত্র যারা বেনজির হত্যা পরিকল্পনায় জড়িত ছিল তারাও নিহত হয়েছে।
বেনজিরকে হত্যার জন্য আত্মঘাতী বেল্ট সরবরাহ করেছিল আবদুল্লাহ নামের যে ব্যক্তি সেও ২০০৮ সালের মে মাসে নিহত হয়।
রাওয়ালপিণ্ডিতে বেনজির তার শেষ বক্তৃতা দেওয়ার সময় খালিদ শাহেনশাহ নামে তার যে নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন তাকেও পরে মেরে ফেলা হয়। বেনজিরের বক্তৃতার সময় শাহেনশাহ তাকে বিপদ সম্পর্কে বারবার সতর্ক করেছিলেন।
এরপর খুন হয়েছেন রাষ্ট্রীয় কৌসুলি চৌধুরি জুলফিকার। নামীদামী এ আইনজীবী বেনজির ভুট্টো হত্যায় সতি্যকারভাবেই যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করছিলেন। ২০১৩ সালের মে মাসে ইসলামাবাদের রাস্তায় তিনি খুন হন।
হামলায় সহায়তাকারী দ্বিতীয় ব্যক্তি এখনো জীবিত:
বেনজিরের হত্যাকারী বিলালের সঙ্গে থাকা আরেকজন আত্মঘাতী হামলাকারী ইকরামুল্লাহকে মৃত বলে দাবি করা হয়ে আসলেও আসলে তিনি এখনও জিবীত।
বিলাল হামলা চালাতে সক্ষম হয়ে যাওয়ায় ইকরামুল্লাহকে আর কিছু করতে হয়নি। তিনি অক্ষত অবস্থাতেই পালিয়ে যান।
পকিস্তানের কর্মকর্তারা বছরের পর বছর ধরে বলে আসছেন, ইকরামুল্লাহ ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন। এবছর প্রধান কৌসুলি মোহাম্মদ আজহার বিবিসি কে বলেছেন, পাকিস্তানের তদন্ত সংস্থাগুলো এমনকি সরকারি কর্মকর্তারাও বলছেন যে, ‘ইকরামুল্লাহ মৃত।’
কিন্তু এ বছরই অগাস্টে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত ২৮ পাতার একটি মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীর তালিকায় ৯ নাম্বারে দেখা গেছে ইকরামুল্লাহর নাম। তালিকায় বলা হয়েছে, দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের এ বাসিন্দা বেনজির ভুট্টো ওপর হামলায় জড়িত ছিলেন।
বিবিসি’র তথ্যমতে, ইকরামুল্লাহ এখন আফগানিস্তানে আছেন। সেখানে মাঝারি পর্যায়ের পাকিস্তানি তালেবান কমান্ডার হিসাবে কাজ করছেন তিনি।
দুই পুলিশ কর্মকর্তারা সাজা:
বেনজির ভুট্টো হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত যে দু’জন ব্যক্তির সাজা হয়েছে তারা হচ্ছেন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। দায়িত্বে অবহেলার কারণে তাদের সাজা দিয়েছে আদালত।
কিন্তু পাকিস্তানে অনেকেই মনে করেন, তাদের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। কারণ, পুলিশ ওপরের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের কাজ করেছে।
এ বিষয়টি থেকেও পাকিস্তানের বেনজির হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিয়ে রাখারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সূত্র : বিডিনিউজ