ঢাকা: ঈদ সামনে রেখে রাজধানীতে বেড়েছে মৌসুমী ভিক্ষুক। প্রায় ৫০ হাজার মৌসুমী ভিক্ষুক এখন ঢাকায়। অপেক্ষাকৃত বেশি আয়ের আশায় সারাদেশ থেকে রাজধানীতে ছুটে আসছে এসব ভিক্ষুক। ঈদের পরে ওরা ঢাকা ছাড়বে। রাজধানীর প্রায় প্রতিটি রাস্তাঘাট, মার্কেট, বাসাবাড়ি, দোকানপাট, অফিস আদালত, বাসস্ট্যান্ড, ৩ বাস টার্মিনাল, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, কমলাপুর রেলস্টেশন, মসজিদ প্রভৃতি এলাকায় দল বেধে ভিক্ষুকরা ভিক্ষায় নেমেছে। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন রোডের সিগন্যালের সামনেও এখন ভিক্ষুকের ভিড়। এসব মৌসুমী ভিক্ষুকের কারণে পথচারীরা রীতিমতো বিব্রত।
নাম আব্দুল হাকিম ভিক্ষা করছেন রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডে। তিনি জানান, ‘ভিক্ষে তার পেশা নয়। মোটা অংকের টাকা আয় করার উদ্দেশ্যেই ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মৌসুমি ভিক্ষুক নিজে থেকেই আসে রাজধানীতে। আবার অনেককে ঢাকায় ১ মাস বিশেষ চাকরির কথা বলে নিয়ে আসা হয়।’ প্রথমে কথা বলতে রাজী না হলেও এক পর্যায়ে আব্দুল হাকিম জানান, ‘গাইবান্ধা তার জেলা তিনি সহ ৫ জন ঢাকায় এসেছেন ভিক্ষা করতে। গত বছর শবেবরাতের সময় থেকে ঈদের পরের দিন পর্যন্ত তার আয় হয়েছিল ৪৭ হাজার টাকা। এবারেও এমনটাই হবে বলে আশা করছেন তিনি। তবে প্রতিদিন অন্যদেরকে চাঁদা দিতে হয়। তা না হলে ঢাকা শহরে ভিক্ষা করা যায় না।’
এ ভিক্ষাবৃত্তির কাজে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে শিশু এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীরা। আইনে নিষিদ্ধ থাকার পরও অবাধে চলছে বিকলাঙ্গ, মানসিক ভারসাম্যহীন, প্রতিবন্ধী ও ছোট্ট পথশিশুদের নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি বাণিজ্য। মিরপুর, ফার্মগেট, মহাখালী, বনানী, হাইকোর্ট, গুলিস্থান, পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে হাত-পা নেই, শারীরিক প্রতিবন্ধী, অন্ধ ও কঙ্কালসার দেহের পুরুষ, নারী ও শিশু অংশ নিয়েছে ভিক্ষাবৃত্তিতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক ভিক্ষুকদের সর্দার যার অধিনে বেশকিছু ভিক্ষুক থাকে। আবার রমজান, ঈদ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নিয়ে আসা হয়। বিভিন্ন বস্তিতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আর দিনশেষে ভিক্ষাবৃত্তির অর্ধেক টাকা তারা ভাগ করে নেয়।
ময়মনসিংহ থেকে এই রমজানা মাসে ঢাকায় ভিক্ষা করতে আসা মো. বাতেন ফার্মগেটে ভিক্ষা করছেন তার প্রথম অভিযোগ সে শহরের যেখানেই ভিক্ষা করতে যাচ্ছে সেখানেই আগে থাকা ভিক্ষুরা বাধা দিচ্ছে। ভিক্ষুকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। মো: বাতেন বলেন, গতবার রোজার শুরু থেকে ঈদের পরের দিন পর্যন্ত তার আয় হয়েছিল ৩৫ হাজার টাকা। রোজার ২ দিন আগে ঢাকায় এসেছে সে। এবার আয়-ইনকাম ভালো না জানিয়ে সে বলে ঈদের পরের দিন চইল্লা যামু। বাতেনের প্রায় পাশাপাশি ভিক্ষা করছে তবারুল নামের আরেক ভিক্ষুক তিনি জানান, ‘তার বাড়ি নেত্রকোনা কিন্তু সে কিশোরগঞ্জে দিনমজুরের কাজ করে ভিক্ষা তার পেশা নয়। রমজান মাসে মানুষ বেশি টাকা দেয় বলে তিনি শুধু রমজান মাসে এ পেশায় নামেন। তিনি বলেন, একমাসে কমের কম প্রায় ৫০ হাজার টাকা আয় হয়।’
হাইকোর্ট এলাকার এক ভিক্ষুকে গড় প্রতি গড় ইনকাম কেমন জানতে চাইলে সে জানায়, ‘রমজানে একজন ভিক্ষুকের প্রতিদিন গড় আয় ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। রমজান-ঈদে ইনকাম ভালো এবং ফিতরার অর্থ ও যাকাতের কাপড়ের আশায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অভাবি মানুষরা আশে।’ নিউমার্কেটে শপিংএ আশা মধ্যে বয়সী স্কুল শিক্ষিকা ফেরদৌসি খাতুন বলেন, ‘ঢাকায় এত ভিক্ষুক কাকে দান করব তা নিয়ে আমরা বিপাকে পড়ি। শুনি অনেকেই ব্যবসা করছে। কে যে গরিব আর কে যে প্রতারক বোঝা যায় না।’
রাজধানীর গুলশান, বারিধারা, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা এসব অভিজাতপাড়ায় যাকাত-ফিতরার টাকা তুলনামূলক বেশি পাওয়া যায়। এজন্য টাকা আদায়ে ছিন্নমূলদের প্রধান টার্গেট থাকে এসব এলাকা। এখন শহরের বিপণিবিতানের সামনে এবং ট্রাফিক সিগন্যালে যানবাহন আটকে গেলে ঘিরে ধরে ভিক্ষুকের অসংখ্য হাত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, ফরিদপুর, মাদারিপুর, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছে বেশিরভাগ মৌসুমী ভিক্ষুক। তাদের থাকার জন্য রাজধানীর বিভিন্ন বস্তি এবং রাস্তায় থাকার ব্যবস্থা করে বিশেষ উপার্জনের উদ্দেশ্য তাদের দিয়ে ভিক্ষা করাচ্ছে অসাধু সিন্ডিকেট।
ভিক্ষুকরা জানান, ‘ভিক্ষাবৃত্তিকে কেন্দ্র করেও চলে চাঁদাবাজি। অনেক পয়েন্টে লাইনম্যান ভিক্ষুকদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তদের আছে আলাদা সিন্ডিকেট। তারা সবাই অন্য ভিক্ষুদের কাছে চাঁদা নেয়।’
তারা জানায়, শবে-বরাত ও ২ ঈদে বাড়তি আয়ের লক্ষ্য নিয়ে তারা নানা প্রলোভনে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে নারী-পুরুষ ও শিশুদের অগ্রীম টাকা দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ভিক্ষার অর্ধেক টাকা দিতে হয় এ চক্রের তহবিলে।