Sun. Apr 20th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

6 রবিবার, ৩০ আগস্ট ২০১৫
ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে ‘অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য’র মাধ্যমে সীমান্ত পথে ভারত থেকে প্রতি দিন বাংলাদেশে ঢুকছে বিপুলসংখ্যক গরু। পাশাপাশি আসন্ন দুর্গোৎসব উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকেও ভারতে যাওয়া শুরু করেছে পদ্মার ইলিশ। কোরবানির পশুর ঘাটতি মেটাতে ভারতসহ মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তান থেকে ১০ লাখ পশু (গরুসহ) আমদানি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ভারত থেকে গরু আসা শুরু করেছে। এতে কোরবানির চাহিদা অনুযায়ী দেশের হাটগুলোতে পর্যাপ্ত পশু থাকবে বলে নিশ্চিত করেছে সরকারের সংশ্লিষ্টরা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গরু ও ইলিশ- এই দু’টো অপ্রচলিত পণ্য রফতানিতে দুই দেশেই সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা বহাল আছে। তবে সম্প্রতি বাণিজ্যিক কূটনীতিতে এ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক ও অলিখিত সমঝোতার পথ তৈরি হয়। এরপরই বৈধ ও অবৈধ উভয় প্রক্রিয়ায় সীমান্ত পথে শুরু হয়েছে গরু-ইলিশের বাণিজ্য। এই ‘অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য’ অন্তর্র্বতী সময়ের জন্য। ঈদুল আজহা ও দুর্গোৎসবের পর এটি আবার আগের অবস্থানে চলে যাবে। অর্থাৎ গরু ও ইলিশ আসা-যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দৃশ্যত পুনর্বহাল হবে।

আরও জানা গেছে, আগামী অক্টোবরের দিকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য আসছে শারদীয় দুর্গোৎসব। ওই উৎসবে অতিথি আপ্যায়নের জন্য প্রচুর পরিমাণ ইলিশের প্রয়োজন হয়। সেখানে বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশের ব্যাপক কদর রয়েছে। একইভাবে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে উদযাপিত হচ্ছে মুসলমানদের বৃহত্তর ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। এই ঈদে দেশে অন্তত ১০ লাখ পশুর ঘাটতি তৈরি হয়। যার ৮০ শতাংশের জোগান দেয় ভারত। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে প্রতি বছর কোরবানির পশুর চাহিদা তৈরি হয় ৭০ লাখের মতো। দেশের ভেতরে এর জোগান আছে ৬০ লাখ। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে ১০ লাখ- যা দেশের মোট চাহিদার ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ। এই ঘাটতি ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হবে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে এখন গরুর সংখ্যা দুই কোটি ৮৬ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি ৭৫ লাখ গাভী। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও মাংস ব্যবসায়ীদের হিসাবে, দেশে বছরে ১ কোটি ৪০ লাখের মতো গরু ও মহিষ জবাই হয়। এর ৬০ শতাংশই হয় কোরবানির ঈদে।

এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব আলী নূর জানান, কোরবানিতে ৩০ লাখ গরু ও ৬৯ লাখ ছাগল-ভেড়া ও মহিষ রয়েছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদার শতকরা প্রায় ৯০ শতাংশ নিজস্ব উৎপাদন থেকে আসছে। তবে কোরবানির সময় এটি মোট চাহিদার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ঘাটতি থাকে। যুগ যুগ ধরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য কিংবা আমদানির মাধ্যমে তা পূরণ করা হয়। তিনি বলেন, এ বছরও তার ব্যতিক্রম হবে না। কোরবানির হাটগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী পশুর সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সরকারের ব্যাপক উদ্যোগ আছে। পশুর কোনো সংকট থাকবে না।

তিনি আরও বলেন, স্থানীয়ভাবেও আমাদের উৎপাদন বাড়ছে। ইতিমধ্যে বিফ ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ১৬ হাজার গরু বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাংস উৎপাদন উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। প্রায় প্রতি মাসে আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ গরু এ প্রকল্পের আওতায় আনা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় উৎপাদিত প্রতিটি গরু থেকে ৭০০ থেকে ৮০০ কেজি মাংস হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, আর দুই-এক বছর অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। এর মধ্যেই আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠব। আর আগামী ৫ বছরের মধ্যে আমরা মাংস রফতানিতে পা রাখব।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বর্তমান সরকারের কঠোর নীতিমালার কারণে সে দেশ থেকে গরু আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। আশংকা ছিল, এ কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে আগামী কোরবানি ঈদের সময় এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু এখন সেই আশংকা দূর হতে যাচ্ছে। দুই দেশের সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের কারণে কোরবানির চাহিদা মেটাতে অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও ভারতই হবে গরু আমদানির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দেশ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আসন্ন কোরবানিতে দেশে পশুর সংকট নিরসনে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ রয়েছে। ভারত সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বজায় থাকলেও তা প্রতিবেশী ও মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের প্রতি ধর্মীয় সহানুভূতির কারণেই শিথিল থাকবে। বাংলাদেশ সরকারও যতটা সম্ভব বৈধ উপায়ে গরু আমদানির চেষ্টা করবে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, তাদেরও কিছু চাওয়ার আছে। সামনে দুর্গোৎসব। সেখানে ইলিশের প্রচুর চাহিদা তৈরি হবে। পদ্মার ইলিশের প্রতি তাদের দুর্বলতা আছে। বাংলাদেশ সরকারও এটি সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখছে। বৈধ উপায়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতি দিন বাংলাদেশ থেকে পদ্মার ইলিশ যাচ্ছে ভারতে। ওই কর্মকর্তা মনে করেন, ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ। তাদের সঙ্গে আমাদের যুগ যুগ ধরে এই অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য চলে আসছে। বাংলাদেশ-ভারত উভয় সরকারের ইতিবাচক মনোভাব ও পদক্ষেপের ফলেই কড়াকড়ি সত্ত্বেও এই অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারত থেকে গরু আমদানির জন্য সীমান্তে ৩১টি করিডোর রয়েছে। সবচেয়ে বেশি করিডোর ১২টি রয়েছে রাজশাহী অঞ্চলে। এছাড়া যশোর, খুলনা, সিলেট ও চট্টগ্রামেও গরু আমদানির করিডোর রয়েছে। এসব করিডোর থেকেই অবৈধ পথে আসা পশু বৈধ করা হয়। সরকারি নিয়মানুসারে প্রতিটি গরু-মহিষের জন্য ৫০০, দুম্বা বা ছাগলের জন্য ২০০ এবং উট, গাধা বা ঘোড়ার জন্য ৬ হাজার টাকা রাজস্ব দিতে হয়। তবে এ অর্থ আদায় করা হয় পশু বিক্রির মূল্য হিসেবে।

সম্প্রতি হিন্দুস্থান টাইমসের প্রতিবেদনে এ বিষয়ে দাবি করা হয়েছে, প্রতি বছর ভারত থেকে ২০ লাখ গরু বাংলাদেশে পাচার হয়। এতে বাংলাদেশে ৬০ কোটি ডলার বা ৪ হাজার ৬৮০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়।

এ প্রসঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর নাজমুল হক বলেন, মূলত জেলার জোহরপুর, জোহরপুর টেক, নারায়ণপুর ও ওয়াহিদপুর সীমান্ত পথে ভারত থেকে গরু-মহিষ আসছে। এছাড়া জেলার আরও কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে খুবই সীমিত আকারে গরু আসছে। এই জেলার সীমান্ত পথে দৈনিক এক থেকে দেড় হাজার গরু-মহিষ ভারত থেকে আমদানি অব্যাহত রয়েছে। পদ্মায় পানি বৃদ্ধির কারণে গরু চলাচলে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের নজরদারি শিথিল করা হয়েছে। বাড়ছে গরু আমদানি। পশ্চিম বঙ্গের কয়েকটি জেলার সীমান্ত দিয়ে গরু আসতে শুরু করেছে। শিগগিরই ভারত সীমান্তের ৩১টি করিডোর দিয়েই অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের মাধ্যমে গরু আমদানি শুরু হবে। তবে গরু নিয়ে এই অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে কোনো অবস্থাতেই যাতে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি ও গোলাগুলির ঘটনা না ঘটে সে বিষয়েও সতর্ক থাকবে দুই দেশ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক মাস ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের চারটি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ভারত থেকে প্রতি দিন ১২০০ থেকে ১৫০০ গরু আসছে। গরু ব্যবসায়ীরা সীমান্তের এপারে নির্ধারিত বিওপি পয়েন্টে গরু এনে শুল্ক বিভাগের নির্ধারিত রাজস্ব গরুপ্রতি ৫শ’ টাকা করে পরিশোধের পর সেগুলো নিয়ে রাজশাহীর সিটি হাটে চলে যাচ্ছেন। অন্যদিকে রাজশাহীর মাঝাড়দিয়াড়, শ্যামপুর নওগাঁর সাপাহার, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি, দিনাজপুরের বিরল, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রামসহ উত্তরের আরও কয়েকটি জেলার সীমান্ত পথে সীমিত আকারে গরু আসছে ভারত থেকে।

স্থানীয় গরু ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম জানান, এক সময় রাজশাহীর বিভিন্ন সীমান্ত পথে প্রতি দিন ভারত থেকে কয়েক হাজার গরু-মহিষ এসেছে। কিন্তু বছর দুয়েক থেকে রাজশাহীর সীমান্ত পথগুলো দিয়ে আর গরু-মহিষ আসতে দিচ্ছে না ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বিএসএফ। বর্তমানে ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি গরু-মহিষ আসছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৪টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে। এই আসা অব্যাহত থাকলে আসন্ন কোরবানির চাহিদা কিছুটা হলেও পূরণ হবে। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরোপুরি না হলেও রাজশাহীর মাঝাড়দিয়াড়, শ্যামপুর নওগাঁর সাপাহার, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি, দিনাজপুরের বিরল, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রামসহ উত্তরের আরও কয়েকটি জেলার সীমান্ত পথে সীমিত আকারে গরু আসছে ভারত থেকে।

এদিকে দেশের সর্ববৃহৎ গবাদি পশুর হাট রাজশাহীর সিটি হাটের মালিক আতিকুর রহমান কালু বলেন, দেশে সাধারণ সময় ও কোরবানি উপলক্ষে রাজশাহীর সিটি হাট থেকেই অর্ধেক গরু-মহিষ সরবরাহ করা হয়। কিন্তু গত দুই বছরে রাজশাহী অঞ্চলের সীমান্ত পথগুলো দিয়ে গরু-মহিষ আসা কমে যাওয়ায় এর আমদানিও কমে গেছে। তবে তিনি বলেন, গত কয়েক মাস ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত পথে আসা দেড়-দুই হাজার গরু-মহিষ সিটি হাটে উঠছে। সপ্তাহে দু’দিনের হাটে ৫ থেকে ৭ হাজার করে গরু আমদানি হচ্ছে। বড় আকৃতির এসব ভারতীয় গরু কোরবানি উপলক্ষে ভারত থেকে আসছে। তিনি আরও বলেন, এবারের কোরবানিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের চলমান সীমান্ত পয়েন্টগুলো আমাদের বড় ভরসা। এগুলো শেষ পর্যন্ত চালু থাকলে কোরবানির গরুর চাহিদার একটা অংশ পূরণ করা সম্ভব হবে।