খোলাবাজার ঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতার জন্য উন্মাদ হয়ে আছেন মন্তব্য করে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘ক্ষমতাশীনরা নোংরা ভাষায় কথা বলে, তাদের কথার জবাব দিতেও লজ্জা লাগে।’
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে বিএনপির ৩৭তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর আলোচন সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ক্ষমতার পালাবদলের ক্ষেত্রে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগকে প্রধান্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বড় দুটি দল। আর যারা আছে, জনগণ তাদের কাছে কোনো দিন যাবে না।’
তিনি দাবি করেন, ‘আওয়ামী লীগ তাদের রাজনীতি থেকে কমিটমেন্ট থেকে দূরে সরে গেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যতদিন পরগাছা থাকবে ততদিন আওয়ামী লীগ শুকিয়ে যাবে।’
বক্তব্যের শুরুতেই দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছা জানান বিএনপি চেয়ারপারসন।
এর পর তিনি বলেন, ‘বিএনপি এখন অনেক বড় দলে পরিণত হয়েছে। হলরুমে প্রোগ্রাম করা যায় না। আমাদের কর্মসূচি পালনের জন্য মুক্ত অঙ্গন প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘দলের প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে সারাদেশে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল কিন্তু বর্তমান অনির্বাচিত স্বঘোষিত সরকার তা করতে দেয়নি।’
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বলতে গিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি গাড়িতে সারাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। আপনারাও ঘুরেছেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান পায়ে হেঁটে সারাদেশ ঘুরেছেন। মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। গ্রামের উন্নয়ন করেছেন।’
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি দাবি করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষের জীবনে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। এ অবস্থার অবসান চাই।’
সরকারের নীতির কারণে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করে তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগকে কি মানুষ মারার লাইন্সেস দেয়া হয়েছে? ছাত্রলীগ মানুষ মারছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশ দিনে দিনে গরীব হয়ে যাবে।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘পুলিশসহ অন্যান্য এজেন্সি যেসব অপকর্ম করছে তার দায় হাসিনাকে নিতে হবে। হাসিনার নির্দেশ ছাড়া তারা এসব করেনি। সব দায় হাসিনার। তাকে জবাবদিহি করতে হবে। তারা গুমের সঙ্গে জড়িত বলে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস পালন করতে দেয়নি। এসব ঘটনায় হাসিনা মদদ দিয়ে সাধু সাজার চেষ্টা করছে।’
গুমের ঘটনায় আবারো জাতিসংঘের অধীনে দেশীয় নিরপেক্ষদের নিয়ে আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য পূরণে কাজ করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিরোধী এ নেত্রী বলেন, ‘আমরা প্রতিশোধ, প্রতিহিংসার রাজনীতি করি না। জাতীয় ঐক্যের রাজনীতি করবো, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবো।’ নষ্ট নেতাকর্মীদের কাউন্সিলিং করার পরামর্শ দেন খালেদা জিয়া।
বিচারবিভাগ সম্পর্কে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আগে জজ সাহেবদের সোশ্যাল ফাংশনে দেখা যেতো না। এখন তারা পাবলিকলি পলিটিক্যাল বক্তব্য দিচ্ছে। এটা অন্যায়।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট বাড়ানোর বিরোধীতা করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘বিএনপির সময় সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দেয়া হয়। এখন এখানে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষার্থীরা রোজগার করে না। এত টাকা তারা কোথায় পাবে? শিক্ষার্থীদের পক্ষ হয়ে আমরা এ ভ্যাট প্রত্যাহারের কথা বলেছি। কিন্তু তা হয়নি। আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবো। এর বাস্তবায়ন করতে দেয়া হবে না।’
এসময় নারী ও শিশু নির্যাতনে ঘটনা বলতে গিয়ে লজ্জা প্রকাশ করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ‘একজন মহিলা হিসেবে বলতে লজ্জা হয় যে নারী নির্যাতন হচ্ছে। ছোট ছোট মেয়েরাও নির্যাতনের শিকার হয়। আমরা এসব নিয়ন্ত্রণ করবো।’
ক্ষমতাসীন দল তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করছে না উল্লেখ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাজারে ৫০টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। ১০ টাকায় চাল নেই ৪০ টাকা চালের কেজি। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ নেই, আছে লোডশেডিং, চাকরি নেই আছে বেকারত্ব, কৃষকরা বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ পায়নি, কৃষি উপকরণের দাম বিএনপির সময় থেকে তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে।’
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিব আহসান মাদক মামলায় গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘দেশের ছাত্ররা ড্রাগ নেয়, পরিকল্পিতভাবে এটা প্রচার করা হচ্ছে।’
‘দেশে গণতান্ত্রিক শক্তি দুর্বল হলে জঙ্গিবাদ বা উগ্রশক্তির উত্থান ঘটবে’ আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদের এ বক্তব্যের কথা উল্লেখ করেন খালেদা বলেন ‘মওদুদ আহমদের বক্তব্যের সঙ্গে একটু দ্বিমত করছি। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশে কোনো জঙ্গিবাদ নেই। এদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান আমরা হতে দেবো না।’
দল পুনর্গঠন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিএনপি প্রধান বলেন, ‘ঘর গোছানো শুরু হয়ে গেছে। দলের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য আছে। দলের কর্মসূচি পালনে জীবন বাজি রাখতে পারে তারাই সামনের সারিতে আসবে। আর যারা ফাঁকিবাজ। মিথ্যা কথা বলে আওয়ামী লীগের মতো, তাদের দল থেকে বের করবো না, তাদের একটু পেছনের সারিতে রাখা হবে।’
খালেদা জিয়ার এ বক্তব্যের সময় উপস্থিত নেতাকর্মীরা ‘দালাল মুক্ত বিএনপি চাই’ শ্লোগান দেয়।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে অনেক দিন ধরে আছি। আমি অনেককে নাম ধরেই চিনি এবং জানি। দলকে শক্তিশালী করতে হবে।’
পকেট কমিটি তৈরি না করতে নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান বিএনপি প্রধান।
খালেদা জিয়া এসময় প্রধান দুটি দাবি তুলে ধরে বলেন, ‘নাম যা-ই দেন না কেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে।’
পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের কঠোর সমালোচনা করে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অথর্ব নির্বাচন কমিশন বাতিল করতে হবে। তারা ১৪/১৫ বছর বয়সের শিশুদেরও ভোটারা বানিয়েছে।’
সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভারতের নির্বাচন কমিশন, পুলিশ এবং ব্রিটেনের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদাহরণ হিসেবে দেখান তিনি।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘মানুষ এখন পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছে। গণতান্ত্রিক উপায়ে সে পরিবর্তন ঘটবে।’
আলোচনা সভায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, ‘৮ বছর ক্ষমতায় নেই। গ্রাম থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের নেতারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অত্যাচার সহ্য করে দলের প্রতি আনুগত্য দেখাচ্ছে তা বিশাল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘দেশে ভয়ঙ্কর অবস্থা বিরাজ করছে। গণতান্ত্রিক শক্তি দুর্বল হলে জঙ্গিবাদ এবং উগ্রশক্তির উত্থান ঘটবে। আভ্যন্তরীণ কোন্দলে আওয়ামী লীগ আরো দুর্বল হবে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হলে আন্দোলন জোরদার করতে হবে।’
স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ বলেন, ‘বিএনপি সবচেয়ে জনপ্রিয় দল আর আওয়ামী লীগ সবচেয়ে ঘৃণিত দল হিসেবে পরিণত হয়েছে। বিএনপি নেত্রী প্রত্যেক প্রতিশ্রুতি পালন করেছেন। আমাদের দুর্দিন নেই। দুশ্চিন্তা আওয়ামী লীগের।’
আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন বিএনপির মুখপাত্রের দায়িত্বে থাকা আর্ন্তজাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন। অন্যদের মধ্যে জমির উদ্দিন সরকার, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমির খসরু মাহামুদ চৌধুরী, ব্যারিস্টার খন্দকার মাহাবুব হোসেন, রফিক শিকদার প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
দিনভর দফায় দফায় বৃষ্টিতে রাজধানীতে ভয়বাহ জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। ফলে নগরজুড়ে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। যার প্রভাব পড়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায়। বিকেল ৩টায় অনুষ্ঠান শুরু হওয়া কথা থাকলেও অনুষ্ঠান শুরু হয় ৫টায়।
বেগম খালেদা জিয়া অনুষ্ঠান স্থলে আসার জন্যে বিকেল সাড়ে ৩টায় তার গুলশানের বাসা থেকে বের হন আর অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান বিকেল সোয় ৬টায়। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিকেল ৫টায় কোরআন তেলাওয়াত, জাতীয় সঙ্গীত এবং দলীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে আলোচনা সভার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। প্রায় এক ঘণ্টা বক্তব্য দেন বিএনপি চেয়ারপারসন। সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ দলের সাংগঠনিক অবস্থা এবং সম্ভাব্য নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ফুটে ওঠে খালেদা জিয়ার বক্তব্যে।
(খোলাবাজার/জিএম/০১-০৯-২০১৫)