Mon. May 5th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

1রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫
বিএনপিকে শক্তিশালী করতে পুনর্গঠনের আওয়াজ অনেকটা ফিঁকে হয়ে আসছে। সঠিক নেতৃত্বের দায়িত্ব আরো যোগ্যদের নিকট তুলে দেয়ার আহ্বান আবারো আটকে যাচ্ছে সিদ্ধান্তহীনতায়। কেন্দ্রের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া থমকে আছে ঘোষণার মধ্যেই।

সারাদেশে বিভিন্ন ইউনিট কমিটি গঠনে চলছে স্বেচ্ছাচারিতা আর অনিয়মের মহোৎসব। দায়িত্বশীল নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়া ছাড়া ভাগ্যে জুটছে না পদ-পদবি। কেন্দ্রের কাছে অভিযোগ জানিয়েও লাভ হচ্ছে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা কেন্দ্র পর্যন্ত আসার ক্ষমতাও রাখেন না। তাই তারাও চুপ। এমনটাই অভিযোগ দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের।

শুধু বিএনপি নয়, দলের সব অঙ্গ-সংগঠনের ক্ষেত্রেও একই চিত্র বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। আবার অনেক এলাকাতে কেন্দ্রের নির্দেশনার পরও শুরু হয়নি পুনর্গঠনের প্রাথমিক কার্যক্রম। কবে শুরু করবেন তাও বলতে পারেননি নেতারা। আর এভাবে যাচ্ছেতাই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়াই ভেস্তে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দলের নেতাকর্মীরা জানান, বিএনপিতে ত্যাগী ও রাজপথে পরীক্ষিতদের বাদ দিয়ে পকেট কমিটি গঠনের অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। এ জন্য দলটি আন্দোলন ডেকেও সফলতার ফসল ঘরে তুলতে না পারার স্বাদ পেয়েছে অনেকবার। ২০০৭ সালে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে বিএনপির রাজপথের কোনো আন্দোলনই আলোর মুখ দেখেনি। এ জন্য নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতাকেই দায়ী করছেন দলটির সিনিয়র নেতারা। তবে এ সংকট সমাধানে বার বার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা সফলতার মুখ দেখেনি।

দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সিল না হওয়া, সারাদেশের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি, ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন করে সুবিধাবাদীদের দিয়ে কমিটি গঠন ও দায়িত্ব প্রদান, নির্যাতিতদের পাশে না দাঁড়ানোর খেসারত হিসেবে বিগত দিনে দলকে চরম মাশুল দিতে হয়েছে। তবে এবার পকেট কমিটি না করে ত্যাগী ও রাজপথে পরীক্ষিতদের দিয়ে কমিটি করার নির্দেশনা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। আর এর পর থেকেই দলটির সুবিধাভোগী নেতারা আতঙ্কে রয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে এবার তারাও দিক পরিবর্তন করে নতুন কৌশলে কেন্দ্র ছাড়াও নজর দিয়েছেন বিভিন্ন ইউনিট কমিটির দিকে। এসব কমিটি গঠনে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখার দিকে।

দলের নেতাকর্মীরা জানান, কমিটি গঠন নিয়ে এই প্রথম প্রকাশ্যে খালেদা জিয়ার এ রকম বক্তব্যে রাজপথে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনে থেকেও যারা মূল্যায়িত হননি তারা আশায় বুক বেঁধেছেন। তারা আশান্বিত দলের চেয়ারপার্সন বুঝতে পেরেছেন- দলকে এই সুবিধাবাদীরাই শেষ করছে, ত্যাগীদের মূল্যায়ন কখনোই হয়নি এই দলে।

নেতাকর্মীরা জানান, চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার এমন কঠোর ঘোষণার পরও থেমে নেই আশীর্বাদপুষ্ট কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া। দলে কোনো মনিটরিং সেল না থাকার কারণে মাঠ পর্যায়ের কোনো তথ্যই নেই দলটির নীতিনির্ধারকদের কাছে। তাই দলের হাইকমান্ড যতই চিৎকার আর চেঁচামেচি করুক না কেন পকেট কমিটি গঠন ঠেকাতে পারবে না বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
তারা উদাহরণ দিয়ে বলেন, রাজধানী ঢাকার একজন কেতাদুরস্ত ব্যবসায়ী মো. সিরাজুল ইসলাম উজ্জ্বল। ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে প্রায় এক যুগ আগে। এখন তাকে পিরোজপুর জেলার কাউখালী উপজেলার ছাত্রদলের আহ্বায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জেলার কমিটি ঢাকাতে বসেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের নেতারা। গত ২৪ আগস্ট তাদের চাপিয়ে দেয়া ১৪টি ইউনিট কমিটি ঘোষণা করেন জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি। প্রায় সবগুলোর অবস্থা একই। জেলা কমিটির অনেক নেতাই জানেন না কোথা থেকে কী হলো। তবে এতটুকু বুঝতে পেরেছেন এই কমিটির বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে তাদের পদ-পদবিতেও টান পড়বে। তাই তারাও চুপ।
কিন্তু বিক্ষুব্ধ সাধারণ কর্মীরা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া এ কমিটির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন। ঝাড়- মিছিল করেছেন। জেলা বিএনপির নেতারাও চাইছেন কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ ছাড়া ছাত্রদের কাছে ছাত্রদলের নেতৃত্ব। তারাও দৌড়ঝাঁপ করেছেন। অভিযোগ জানিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির নিকট। আশ্বস্তও করেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

জেলা ছাত্রদল সূত্র জানায়, সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিব আহসানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক জসিমউদ্দিনসহ কেন্দ্রীয় তিন নেতার বাড়ি এ এলাকায় হওয়ার কারণে তাদের প্রভাবে ও নির্দেশনায় এ কমিটি দেয়া হয়েছে। জেলার নেতাদের ঢাকায় নিয়ে ব্যবসায়ী সিরাজুলকে আহ্বায়কের পদ দিয়েছেন তারা। সিরাজুল ইসলাম উজ্জ্বল মহাখালী এলাকায় বসবাস করেন। তিনি ঢাকাস্থ কাউখালী যুবকল্যাণ সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।

একইভাবে সারাদেশের বিভিন্ন জেলা কমিটির নেতৃত্বাধীন ইউনিট কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে অনিয়মের চিত্র পাওয়া গেছে। কেন্দ্রের সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে জেলা পর্যায়ের চেইন অব কমান্ড এখন বিলুপ্তির পথে। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদল কমিটি ত্যাগী ও রাজপথের নেতাকর্মীদের দিয়ে কমিটি ঘোষণা দিলেও নজিরবিহীনভাবে কেন্দ্র তা স্থগিত ঘোষণা করে। তবে কি কারণে এ স্থগিতাদেশ তা জানে না মহানগর ছাত্রদল। তারা জহিরুল হক টুটুলকে সভাপতি এবং ইফতেখার উদ্দিন নিবলুকে সাধারণ সম্পাদক করে আকবর শাহ থানা কমিটি ঘোষণা করেন। এর ১০ দিন পর কেন্দ্রীয় কমিটির হস্তক্ষেপে তা স্থগিত হয়। অভিযোগ রয়েছে, জেলার এক প্রভাবশালী নেতার সরাসরি হস্তক্ষেপ ও টাকার বিনিময়ে ছাত্রদলের অভিভাবক হিসেবে পরিচিত নেতা এ কমিটি বাতিল করতে কেন্দ্রীয় কমিটিকে বাধ্য করেন।

এক্ষেত্রে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কঠোর নির্দেশনা কিংবা হুঁশিয়ারিতেও কর্ণপাত করছেন না দায়িত্বশীল মহল। সূত্র জানায়, সম্প্রতি দলের ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের উদ্দেশ্য করে বিএনপি প্রধান বলেছেন, এখন মোবাইলের যুগ, অনেকেই ঘরে বসে বলেন আমি এটা করেছি, ওটা করেছি। কিন্তু আমি সব খবর জানি।
তিনি বলেছেন, আমরা দল গোছানোর কাজ শুরু করেছি। নেতাদের বলব দয়া করে কেউ পকেট কমিটি করবেন না। যারা দলের প্রতি অনুগত, আন্দোলনে জীবনবাজি রেখে মাঠে থাকবেন তাদের পদ দেবেন। যারা ফাঁকিবাজ তাদের পেছনে রাখা হবে।

খালেদা জিয়া বলেন, যাদের দলের ও নেতার প্রতি আনুগত্য আছে, কর্মসূচি দিলে জীবনবাজি রেখে লড়াই করবে, দলের নির্দেশ মানবে তাদের নেতৃত্বে আনতে হবে। আর যারা ফাঁকিবাজ ও মিথ্যাবাজ তাদের দল থেকে বের করে দেব না, তবে পেছনের দিকে রাখা হবে। তাহলে দলে গতি আসবে। দয়া করে কেউ পকেট কমিটি করবেন না। এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দলের সুবিধাবাদী নেতাদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, কম-বেশি অনেককে আমি চিনি। নাম ধরে বলতে পারি। এমন অনেককে চিনি যাদের নেতারাও চেনেন না। তাই এখন যা বলবেন সেটাই বিশ্বাস করব এমনটা নয়।
কমিটি গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা খালেদা জিয়ার এ রকম কঠোর নির্দেশনামূলক বক্তব্য শোনার পর নিজেরাও অবাক হয়েছেন।

তারা জানিয়েছেন, নিজেদের পছন্দের লোক দিয়ে কমিটি তৈরি করে আনলেই খালেদা জিয়া আর অনুমোদন দেবেন না। এক্ষেত্রে তিনি তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। কমিটির তালিকা জমা দেয়ার পর বিএনপি চেয়ারপার্সন নিজেও খোঁজখবর নিয়ে যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেবেন।
খালেদা জিয়ার এ রকম মনোভাবের কারণে কমিটি গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারাও নড়েচড়ে বসেছেন। তবে বিএনপিতে দীর্ঘদিন ধরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা একটি চক্র শেষ পর্যন্ত পকেট কমিটির ধারণা থেকে বেরিয়ে ত্যাগী ও যোগ্যদের মূল্যায়ন করবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান নেতাকর্মীরা।

তারা বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার একার পক্ষে সারাদেশের কমিটি গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকা সম্ভব নয়। তিনি হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কমিটির দিকে নজরদারি করতে পারবেন। কিন্তু সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা হাজারো ইউনিট কমিটি তার খেয়াল রাখা সম্ভব নয়। এ জন্য আলাদা সেল থাকা দরকার। তারা তদারকি করবে এসব কমিটি।

নেতাকর্মীরা জানান, রাজপথের আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচন সব পর্যায়ে এসব ক্ষুদ্র ইউনিট কমিটিই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এসব কমিটিকে পকেট কমিটি বানিয়ে রাখলে নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট কমিটি গঠন করলে এর প্রভাব শুধু জেলা পর্যায় নয়, সারাদেশেই পড়বে। শুধু রাজধানীকে সুরক্ষা দিয়ে রাজনীতি সম্ভব নয় বলেও নেতাকর্মীরা জানান।

তবে এসব বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান বলেন, প্রতিটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নতুন কমিটি গঠনে খালেদা জিয়া নিজেই তদারকি করছেন। এক্ষেত্রে কেউ আর পকেট কমিটি দেয়ার সুযোগ পাবে না।