Sun. May 4th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

6খোলা বাজার২৪, শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫
ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেওয়া সরকারের আশ্বাস নিয়ে ‘ফাঁকির’ অভিযোগ উঠেছে; কর বিষয়ে অভিজ্ঞ কয়েকজন দ্বিমত পোষণ করেছেন এনবি আরের ব্যাখ্যার সঙ্গেও।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবি আর) বলছে, শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি বাবদে বিশ্ববিদ্যালয়কে যে অর্থ দেয়, তা থেকে নির্ধারিত হারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকারকে এই ভ্যাট পরিশোধ করবে। তা আলাদা করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হবে না।

তবে ভ্যাটের মৌলিক ধারণার সঙ্গে এনবি আরের ওই নির্দেশনা পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ হল কি না- সে প্রশ্ন তুলেছেন এ সংস্থারই একজন সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা। শিক্ষার মত মৌলিক অধিকার ভ্যাটের আওতায় আসতে পারে কি না- সে প্রশ্নও তিনি রেখেছেন।

তিনি বলেছেন, “ভ্যাট আইনের মূল ফিলসফি হচ্ছে, যিনি সেবা নিচ্ছেন, তিনিই এ কর দেবেন। যেহেতু বিষয়টি নিয়ে একটি জটিলতা হয়েছে, সেহেতু একটু কুল ডাউন করার জন্য এনবি আর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে বলে আমার মনে হয়।”

চলতি বছর বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর সরকার সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করে, যার পর থেকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে আসছে।

ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃহস্পতিবার দিনভর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়ক আটকে বিক্ষোভ করলে যানজটে কার্যত অচল হয়ে পড়ে রাজধানী।

ভ্যাট প্রত্যাহারের বিষয়ে দৃশ্যত অনমনীয় সরকার এই পরিস্থিতিতে হাঠৎ করেই তৎপর হয়ে ওঠে। দুপুরে সরকারের এক তথ্য বিবরণীতে এনবি আরের একটি ‘ব্যাখ্যা’ দেওয়া হয়।
এতে বলা হয়, “শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করার জন্য নতুন করে ভ্যাট আরোপ করা হয়নি। বিদ্যমান টিউশন ফি’র মধ্যে ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ভ্যাট বাবদ অর্থ পরিশোধ করার দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের, কোনক্রমেই শিক্ষার্থীদের নয়।”

‘বিদ্যমান টিউশন ফি’র মধ্যে ভ্যাট ‘অন্তর্ভুক্ত থাকায়’ টিউশন ফি বাড়ার কোনো ‘সুযোগ নেই’ বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।

বিকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও একই সুরে কথা বলেন, যিনি বরাবরই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সমালোচনা করে আসছেন।

সিলেটে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “এ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে হবে। তারা যে হারে টাকা আদায় করে সে হারে এটা দিতেই পারে। তবে কোনো ফি বাড়াতে পারবে না।”

এ নিয়ে জটিলতা আর না বাড়িয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. সহুল আফজাল আন্দোলনকারীদের সামনে এসে ঘোষণা দেন, ‘এনবি আরের সিদ্ধান্ত অনুসারে’ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই ভ্যাটের টাকা পরিশোধ করবে। তার ওই আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা রাস্তা ছেড়ে দেয়। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও একই আশ্বাসে অবরোধ তুলে নেয়।

রাতে জাতীয় সংসদে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেন, “এই ভ্যাট তো ছাত্রদের দিতে হবে না। এটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। এটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে।”

তবে সরকারের এই আশ্বাস নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংশয় প্রকাশ করেন বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন।
তিনি বলেন, “প্রতিষ্ঠান যখন ভ্যাট দেবে, তখন তারা অন্য জায়গা থেকে অর্থ আনবে না। প্রতিষ্ঠান এই ৭ ভাগ ভ্যাট আদায় করার জন্য প্রকারান্তরে শিক্ষার্থীদের বেতনটা বাড়িয়ে দেবে; সেমিস্টার, ল্যাবরেটরি ফিসহ অন্যান্য ফি বাড়িয়ে দেবে।”

গত জুনে অর্থমন্ত্রী যখন সংসদে বাজেট প্রস্তাব তোলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, “ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বিপরীতে বর্তমানে সঙ্কুচিত মূল্য ভিত্তিতে ৭.৫ শতাংশ মূসক (ভ্যাট) প্রযোজ্য থাকলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর বর্তমানে মূসক আরোপিত নেই। খাতগুলোকে মূসকের আওতায় আনার প্রস্তাব করছি। তবে করভার সহনীয় পর্যায়ে রাখার লক্ষ্যে এক্ষেত্রে সঙ্কুচিত মূল্যভিত্তিতে ১০ শতাংশ মূসক নির্ধারণের প্রস্তাব করছি।”

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তখন থেকেই এর প্রতিবাদে সোচ্চার হলে বাজেট পাস হওয়ার সময় ওই হার কমিয়ে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়।

গত ১ জুলাই এনবি আর এ বিষয়ে এসআরও জারি করে, তাতে বলা হয়, “সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সেবার বিনিময়ে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থের শতকরা পঞ্চাশ ভাগের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে” এই কর প্রযোজ্য হবে।”

এখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আয়ের ওপর করকে ভ্যাট বলা হচ্ছে, যার সঙ্গে একমত নন কর বিষয়ে অভিজ্ঞ অনেকে।

এ বিষয়ে এনবি আরের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি’র ওপর আরোপিত ভ্যাট বিষয়ে যে ব্যাখ্যা আপনাদের পাঠানো হয়েছে, সেটাই রাজস্ব বোর্ডের বক্তব্য। এর বাইরে আর কিছু বলতে চাই না।”

বিষয়টি আরও স্পষ্ট করার অনুরোধ করা হলে তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীরা যে টিউশন ফি বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে থাকে, তার মধ্যেই ভ্যাট রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেখান থেকে ভ্যাট আলাদা করে পরিশোধ করবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।”

তবে এনবি আরের এই ব্যাখ্যার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে একজন কর আইনজীবী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যিনি ভোক্তা বা সেবা গ্রহণকারী, তিনিই ভ্যাট দেবেন। এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেবা দিচ্ছে, আর ছাত্ররা তা নিচ্ছে। এক্ষেত্রে ভ্যাট প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না।”
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে কর উপদেষ্টার সেবাদানকারী এই আইনজীবী নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি।

তিনি বলেন, “সমস্ত ভ্যাট যেখানে সেবা গ্রহীতা দিচ্ছে, সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট কেন প্রতিষ্ঠান দেবে- তা একটি বড় প্রশ্ন। এটি একটি ভিন্নতা।

“আমার কাছে মনে হয়েছে, সরকার বা এনবি আর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য, এটা আইনি ব্যাখ্যা না।”

আর শিক্ষা ভ্যাটের আওতায় আনা উচিৎ কি না সে প্রশ্ন তুলে এনবি আরের সাবেক একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন। শিক্ষা একটি অধিকার, এই অধিকার কেউ ১২ টাকা দিয়ে পাবে, আবার কারও অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করে তা নিতে হবে, এই বৈষম্য থাকা ঠিক না।”

অনেকের মত তিনিও মনে করেন, এনবি আর যে ব্যাখ্যাই দিক না কেন, এই অর্থ শেষ বিচারে শিক্ষার্থীদের পকেট থেকেই যাবে।

“সরকারের চাপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন নিজেরা ভ্যাটের টাকা দিলেও কিছুদিন পর হয়তো ফি বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই তা আদায় করে নেবে।