খোলা বাজার২৪ ॥ বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫
ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই। পা রাখারমত বিন্দুমাত্র জায়গা নেই কামলাপুর, সদরঘাট, টিটিপাড়া ও সায়দাবাগ এলাকার টার্মিনালগুলোতে। নাড়ীর টানে বাড়ি ফেরা জন্য শত প্রতিকুল অবস্থাকে উপেক্ষা করে সকলে ছুটছে গ্রামে। যার কারণে উপচে পড়া ভিড় রাজধানীর ট্রেন, বাস ও লঞ্চ টামিনালে। আজ থেকে শুরু হচ্ছে সরকারি ছুটি। কর্মসূত্রে যাদের রাজধানীতে বসবাস, তারা ছুটি পেয়েই যেন বাঁধভাঙ্গা ঢল নামিছেন কমলাপুর রেল স্টেশনে। নি¤œ বিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উ”চ বিত্তের সব শ্রেণির কাছেই নিরাপদ ও আরামদায়ক বাহন হিসেবে জনপ্রিয় রেল। এছাড়া সড়ক পথের যানজট ও এবড়ো থেবড়ো রাস্তার ঝাকুনির ধকল ও বিড়ম্বনা এড়াতেও বেশির ভাগ যাত্রীর কাছে পছন্দ এই যোগাযোগ ব্যবস্থা। সরেজমিন আজ বৃহস্পতিবার কমলাপুর রেল স্টেশনে ঘুরে দেখা গেছে যাত্রীদের ঢল নেমেছে এখানে। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত ছুটছে ঘরমুখো মানুষ। কারণ রাত পোহালেই মুসলমানদের অন্যতম উৎসবের দিন ঈদ-উল-আযহা। ত্যাগের শিক্ষা দেয় এই উৎসব। আর একারণেই মনে হয় রেলের বগিতে তিল ধরণের ঠাঁই না ধাকলেও শেষ মূহুর্তের যাত্রীদের টেনে তুলে নিচ্ছেন আগে থেকেই বাগিতে থাকা যাত্রীরা। কোনো অভিযোগ নেই, নেই কোনো অনুযোগ নেই। বগির ভেতরে গাদাগাদি করে যাওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী সোলায়মান জানান, কষ্ট হলেও বেশিক্ষণের তো বিষয় না। একটু না হয় কষ্ট হল। কিন্তু বাড়িতে পৌঁছেই তো ছেলে-মেয়ে, মা-বাবাকে নিয়ে আনন্দ করব। সকাল থেকেই বাড়তি যাত্রীদের সামাল দিতে কমলাপুর স্টেশনে সার্বক্ষণিক অবস্থান করছেন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফিরোজ সালাউদ্দিন, রেলের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক খলিলুর রহমান, অতিরিক্ত মহাপরিচালক অপারেশন, পূর্বাঞ্চল রেলের মহাব্যাবস্থাপক মকবুল আহমেদসহ সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই রয়েছেন। কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, ঈদের আগের দিন সরকারি ছুটি ও শেষ কর্মদিবস হওয়ায় রেকর্ড সংখ্যক যাত্রী উপস্থিত হয়েছেন কাঙ্খিত গন্তব্যে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তাদের সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিংস্টক) খলিলুর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, গত তিন বছরের মধ্যে এবার সর্বো”চ সংখ্যক যাত্রী রেলে তাদের নিজ নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন। রেল সবসময়ই আরামদায়ক ও নিরাপদ হিবেবে যাত্রীদের কাছে প্রথম পছন্দের নাম। তিনি জানান, রেলের ইতিহাসে এবারই মনে হয় সর্বো”চ সংখ্যক যাত্রী পরিবহন করছে রেল। ঈদের সময় রেলে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ সামাল দিতে এরই মধ্যে অতিরিক্ত বগি ও কোচ সংযোজন করা হয়েছে। ব্যবস্থা করা হয়েছে অতিরিক্ত স্পেশাল ট্রেনের। ফলে সাধারণ সময়ে যেখানে আমরা সর্বো”চ এক লাখ ৭০ হাজারের মত যাত্রী পরিবহন করি, সেখানে এবার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে প্রতিদিন যাতে অন্তত আড়াই লক্ষ যাত্রী বাড়ি গিয়ে পরিজনের সঙ্গে আনন্দ ভাগভাগি করতে পারি। তবে আমাদের ধারণাকেও ছাড়িয়ে গেছে এবার। তার চাইতেও অনেক বেশি সংখ্যক যাত্রী ট্রেনে ভ্রমন করছেন। কারণ হিসেবে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক বলেন, সড়ক পথের যানজট এড়াতেই অধিকসংখ্যক যাত্রীরা এবার রেলে ভ্রমন করছেন। কয়েকটি ট্রেনের সিডিউল বিলম্বের বিষয়ে তিনি বলেন, এ সময়ে যাত্রীর চাপ অত্যাধিক থাকে। তাই এখন স্বাভাবিক গতির চাইতে এখন কম গতি অর্থাৎ নিয়ন্ত্রিত গতিতে ট্রেন চালানোয় কিছুটা সময় লাগছে। তবে এতে যাত্রীরা এখনও খুব একটা হতাশা প্রকাশ করেনি। এদিকে সকাল থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত ১৭ টি ট্রেন কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে গেছে সারাদেশের বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘযাত্রার চারটি ট্রেন নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বিলম্বে কমলাপর থেকে ছেড়ে গেলেও অধিকাংশ ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে নির্ধারিত সময়ে। এরমধ্যে দেওয়ানগঞ্জ বাজার কমিউটার, পারাবত এক্সপ্রেস, এগারসিন্ধু প্রভাতী এক্সপ্রেস, তিস্তা এক্সপ্রেস, মহুয়া এক্সপ্রেস, কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, দেওয়ানগঞ্জ স্পেশাল, একতা এক্সপ্রেস,কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস, বলাকা এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, রংপুর এক্সপ্রেস নির্ধারিত সময়ে কমলাপুর থেকে ছেড়ে গেছে। তবে খুলনার পথে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ৩ ঘন্টা, মহানগরপ্রভাতী নির্ধারিত সময়েরে চেয়ে এক ঘন্টা পনের মিনিট, রাজশাহীর উদ্দেশ্যে ধুমকেতু এক্সপ্রেস ৫ ঘন্টা, ও চট্টলা এক্সপ্রেস দেড় ঘন্টা দেড়িতে কমলাপুর স্টেশন থেকে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে। ঈদে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে রেলের সিডিউল বিপর্যয়ের বিষয়টি অস্বীকার করে পূর্বঞ্চল রেলে মহাব্যবস্থাপক মকবুল আহমেদ জানান, একটা ট্রেন কমলাপুর থেকে গন্তব্যে পৌছে আবার ফিরে আসার ক্ষেত্রে পথে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়। কারণ রেলেরে বেশ কিছু পয়েন্টে উন্নয়ন মূলক কাজ চলছে। দূর্বল সেসব স্থানে গতির বিষয়ে রেস্টিকশন রয়েছে। ফলে নির্ধারিত সময়ে একটি ট্রেন ফিরে আসতে কিছুটা সময় লাগছে। আবার অতি বৃষ্টিতেও ট্রেনের গতি কমিয়ে ট্রেন চালাতে হয় এজন্যও সব সময় সময় মেইনটেন করা সম্ভব হয়না। তিনি বলেন, আবার একটা ট্রেন কমলাপুর ফিরে আসলে সেটার ইঞ্জিন পরিবর্তনসহ ওয়াসপিটে নিয়ে পরিস্কার করতেও প্রায় একঘন্টা সময়ের প্রয়োজন হয়। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সামর্থ অনুযায়ী আপ এণ্ড ডাউনে কিছুটা সময় চলে যায়। এসব কারণেও কিছুটা দেরি হয় পুনরায় একটা ট্রেন ছাড়তে। এদিকে শুধু ট্রেন নয়। সড়ক ও নৌপথেও রয়েছে যাত্রীদের ব্যপক চাপ। শেস দিন হওয়ায় এ চাপ আরো বেশি। যে যেভাবে পারছেন ছুটছে বাড়ির পথে। বাসের ছাদে বাম্পারে ঝুলে, লঞ্চের ছাদে ডেকে কোথাও স্থান নেই তিল ধারণের। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী রাস্তার কারণে যানজট হবে না এমন কথা বার বার বললেও বাস্তবতা ভিন্ন। সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কের প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার সড়ক পথ বৃষ্টিতে ব্যপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আর এরমধ্যে প্রায় বার’শ কিলোমিটার বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ এসব সড়কে যানবাহন চলছে ঝৃকি নিয়ে। আর যানবাহনের ধীর গতির কারণে মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে তৈরী হচ্ছে তীব্র যানজটের। তারপরও সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে রয়েছে ১৮৭ টি অস্থায়ী পশুর হাট। আবার কোথাও কোথাও বসেছে ঈদের বাজার। এসব অপসারণের জন্য বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হলেও শেষ পর্যন্ত তা অপসারণ সম্ভব হয়নি। আবার ঈদ উপলক্ষে পরিবহন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে রয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বাস শ্রমিকরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের পাশাপাশি ছাদে যাত্রী উঠিয়ে আদায় করছে ভাড়া। বুধবার ঈদের শেষ কর্মদিবসের দুপুর থেকেই ব্যাপকভাবে রাজধানী ছাড়তে শুরু করে নগরবাসী। বাস, লঞ্চ, ট্রেন সব পরিবহনই যাত্রীতে ঠাসা। তবে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়েছে ট্রেনে। আজ বৃহস্পতিবার থেকে ঈদের ছুটি শুরু হওয়ায় বাধভাঙ্গা জোয়ারের মত মানুষ ছুটছেন। সবচেয়ে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা যায় ট্রেনের বগিগুলোতে। যাত্রী দূর্ভোগ ও নিরাপদে সড়ক ভ্রমনের বিষয়ে প্রতিদিনই বিভিন্ন বাস টার্মিনাল পরিদর্শন করছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এসময় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে বার বার সতর্ক করলেও মানছে কেউই। সরজমিন গাবতলী বাস টার্মিনাল পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, গাবতলী থেকে পাটুরিয়ার স্বাভাবিক ভাড়া ৭৫ টাকা, সেখানে নেয়া হচ্ছে ২শ’ টাকা। গাবতলী থেকে বালিরটেক স্বাভাবিক ভাড়া ৬৫ টাকা সেখানে নেয়া হচ্ছে ২শ’ টাকা। গাবতলী থেকে হরিরামপুর, ঘিওর, দৌলতপুর, নাগরপুর, ঝিটকা সড়কেও নির্ধারিত ভাড়ার বেশি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেছেন ঘরমুখো যাত্রীরা। দূরপাল্লার পরিবহনেও এই চিত্র। ঈদের আগের শেষ দিন হওয়ায় নৌপথেও ছিল উপচে পরা ভীর। স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ির পথে রওনা হওয়ার পর ঢাকার সদরঘাটে নির্ধারিত গন্তব্যের লঞ্চ না পেয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে কয়েক হাজার যাত্রীকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বি আইডব্লিউটিএ’র পরিবহন পরিদর্শক (টিআই) সৈয়দ মাহফুজুর রহমান জানান, জামাল-৫ বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় পটুয়াখালীর উদ্দেশ্যে সদরঘাট ছেড়ে যায়। এরপর ওই রুটের আর কোনো লঞ্চ ছিল না। পটুয়াখালীর যাত্রী শেফালী বেগম আগের রাত ৮টার দিকে সদরঘাটে আসেন স্বামী, ননদ ও দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে। ঘাটে পৌঁছে তারা জানতে পারেন, পটুয়াখালীর শেষ লঞ্চটিও টার্মিনাল ছেড়ে যাওয়ায় সারারাত অপেক্ষায় থাকতে হয় পরবর্তী লঞ্চের জন্য। কেবল পটুয়াখালী নয়, অন্যান্য রুটের যাত্রীদেরও লঞ্চ না পেয়ে রাতে পন্টুনে অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়। আরেকজন টিআই মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, তিন থেকে চার হাজার যাত্রীকে সারা রাত টার্মিনাল ও পন্টুনে অপেক্ষা করতে হয়েছে। তারা হয় সময়মত আসতে পারেননি, নয়তো ভিড়ের মধ্যে লঞ্চে উঠতে পারেননি। বৃষ্টির মধ্যে নারী ও শিশুদের অনেক কষ্ট হয়েছে।