খোলা বাজার২৪, শনিবার , ১৭ অক্টোবর ২০১৫: মিসবাহ-উল হককে এক পলক টিভি পর্দায় দেখাল। আবেগ প্রকাশে বরাবরই ভীষণ ‘আলসে’ মিসবাহরও অভিব্যক্তি পড়া যাচ্ছিল স্পষ্ট। মাঠে যা ঘটছে, সেটা যে বিশ্বাসই হচ্ছে না—স্পট বলে দিচ্ছিল তাঁর বড় বড় চোখ। বিশ্বাস করা কঠিনই ছিল। টেস্টের পঞ্চম দিন। প্রথম সেশনের প্রথম ঘণ্টাও পার। তবুও শেষ হয়নি ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসই। প্রথম চার দিনে গড়ে চারটি করে উইকেট পড়েছে যে ম্যাচে, সেই ম্যাচটাই এক দিনে ১৫ উইকেটের পতনে ভর করে নাটকীয় মোড় নিয়ে চলে গিয়েছিল ফলাফলের একদম প্রান্তে। জয়ের জন্য আর মাত্র ২৫ রান দরকার ছিল ইংল্যান্ডের। কিন্তু ‘বেরসিক’ আলো সব উত্তেজনার উত্তাপে ঢেলে দিল জল। ৮ ওভার বাকি থাকতেই আম্পায়ার ইতি টেনে দিলেন খেলার। ড্র! ম্যাচের ফলাফলে তা-ই লেখা থাকবে। কিন্তু ‘ম্যাড়ম্যাড়ে নিষ্প্রাণ ম্যাচ কে দেখে’ বলে খোঁজ রাখাই হয়তো বন্ধ করে দিয়েছিলেন যাঁরা, জানতেও পারলেন না, এই ড্রয়ের আড়ালে কী পরিমাণ রোমাঞ্চ নিয়ে শেষ বিকেলে হাজির হয়েছিল আবুধাবি টেস্ট। মরুর বুকে আকস্মিক ঝড়ের কবলে পড়ে দিশেহারা মরুযাত্রীর মতো মনে হচ্ছিল পাকিস্তানকে। দ্বিতীয় ইনিংসে ১৭৩ রানে অলআউট হয়ে চরম নাটকীয়তায় হারের মুখে পড়ে গিয়েছিল তারা। প্রথম ইনিংসে পাওয়া লিডের সুবাদে জয়ের জন্য ১৯ ওভারে ৯৯ রান দরকার ছিল ইংল্যান্ডের। প্রথম ওভারে ৬ রান তুলে নিজেদের লক্ষ্যটাও বুঝিয়ে দিয়েছিল ইংল্যান্ড। ক্রিকেটে নাটকীয় উপাদানের রসদ জোগান দিতে কখনোই কার্পণ্য করেনি যে পাকিস্তান, এই টেস্টের এমন নাটকীয় পরিবর্তনের পেছনেও ব্যাট হাতে ‘অবদান’ রেখেছে যাঁরা, বোলিংয়েই বা চুপ করে থাকবে কেন? টি-টোয়েন্টি স্টাইলে ব্যাটিংয়ে নেমেছিল ইংল্যান্ড। প্রথম চার দিনের অভিজ্ঞতা থেকেই তারা জানত, আলোর স্বল্পতার কারণে পুরো ১৯ ওভার পাওয়া যাবে না। এ কারণে কুক নিজে না নেমে পাঠিয়ে দিলেন মারকাটারিদের। ৩৫ রানে ৩ আর ৬৬ রানে ইংল্যান্ডের ৪ উইকেট ফেলে দিয়ে পাকিস্তানও যেন যোগ করল বাড়তি মসলা। কিন্তু ১১ ওভারে ৭৪ ওঠার পরই দুই আম্পায়ার বলে দিলেন, ‘স্যরি বন্ধুরা, ম্যাচটা আর কিছুতেই চালানো যাচ্ছে না।’ খেলোয়াড়রাও হাত মেলালেন। শুধু নিরপেক্ষ দর্শকেরা যেমনটা ভেবেছিল, সেই শেষ অঙ্কের শেষটাই মিলল না। নিস্তরঙ্গ টেস্টের ঝিনুক-খোলস থেকে রোমাঞ্চের মুক্তো খুঁজে আনার আসল ডুবুরি কিন্তু আদিল রশিদ। পাকিস্তানকে প্রায় একাই ধসিয়ে দিয়েছে দিয়েছিলেন এই পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বোলার। প্রথম ইনিংসে ১৬৩ রান দিয়ে উইকেটশূন্য ছিলেন। অভিষেকে এত রান দিয়ে উইকেটশূন্য ছিল না আর কেউই। দ্বিতীয় ইনিংসে সেই আদিলই ৬৪ রানে নিলেন ৫ উইকেট। মাত্র ৬০ রানে শেষ ৭ উইকেট পড়েছে পাকিস্তানের। পাঁচটিই আদিলের। চতুর্থ দিন থেকেই মরা উইকেটে রীতিমতো ধুলো উড়ছিল। সেটারই সুবিধা তুলে নিয়েছেন ইয়র্কশায়ারের হয়ে খেলা প্রথম পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এই লেগস্পিনার। পাকিস্তানের ইনিংসের ধসটা তাঁর হাতেই শুরু। ৩ রানের মধ্যে দুই ওপেনারকে হারানো; এর পর রান আউটের খাঁড়ায় হাফিজও (৩৪) চলে গেলে পাকিস্তান বিপদে (৪৭/৩) পড়েছিল বটে। কিন্তু তখনো হয়তো কারও মনে হয়নি ‘কিছু একটা হতে পারে’। সবচেয়ে অভিজ্ঞ দুই ব্যাটসম্যান মিসবাহ ও ইউনিসের ৬৬ রানের জুটিটাও রয়েসয়ে ম্যাচের সম্ভাব্য ফল লিখে দিচ্ছিল। কিন্তু পাকিস্তানকে নিরাপদ বৃত্তে ফেরানোর একদম প্রান্তে পৌঁছানোর সময়ই আদিলের আঘাত। নাটকীয় মোড়! ২৬৫ বল লেগেছে যাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট উইকেটের দেখা পেতে, সেই তিনি পরের চারটি উইকেট তুলে নিয়েছেন মাত্র ৩৪ বলের মধ্যে। শেষ তিন উইকেট তুলে নিতে খরচ হয়েছে সাত বল। আদিলের ক্যারিয়ারের প্রথম উইকেটটা এই টেস্টেই পাকিস্তানের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের মালিক হয়ে যাওয়া ইউনিস। দুই ওভার পরেই ফিরিয়েছেন আসাদ শফিককেও। আরেক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মঈন আলী এর পর মিসবাহকে (৫১) ফেরালেই পাকিস্তানের শিরদাঁড়া বেয়ে হয়তো ঠান্ডা স্রোত নেমে যাওয়া শুরু। মাত্র ১৪ রান আর ৫ ওভারের মধ্যেই পাকিস্তান শেষ ৫ উইকেট হারিয়ে অলআউট। বল ঠেকিয়ে যে ইনিংসটাকে লম্বা করবে, সেই সুযোগও পায়নি মিসবাহর দল। প্রথম ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরির পর দ্বিতীয় ইনিংস শূন্য—শোয়েব মালিক যে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছেন এই টেস্টে, আদিল যেন গেলেন ঠিক উল্টো পথে। প্রথম ইনিংসে বোলিংয়ে লজ্জার রেকর্ড গড়া আদিলই এখন গত ২২ বছরে অভিষেকে ৫ উইকেট নেওয়া প্রথম ইংলিশ স্পিনার! আবুধাবি টেস্ট বোধ হয় এমন ক্লাইম্যাক্স আর অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্সের ভেতর দিয়ে যাবে বলেই ঠিক করে রেখেছিল। দর্শককে একটু আঁচ দেবে না বলে সব রোমাঞ্চ শেষ অঙ্কের জন্য জমিয়ে রেখে শুরু থেকে ঢিমে তালে এগিয়ে চলা কোনো মঞ্চ নাটক! কিন্তু এই চিত্রনাট্য কেউ টেবিলে বসে কল্পনার মাধুরী মিশিয়ে লেখে না বলেই হয়তো শেষটা হলো ড্রতেই। খেলার রোমাঞ্চটাও কিন্তু এখানেই