Wed. Aug 6th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খোলা বাজার২৪, সোমবার , ১৯ অক্টোবর ২০১৫ : মাসুম কেন যেন ১৩ নম্বর জার্সি খুব পছন্দ করত। কী 23অদ্ভুত ব্যাপার দেখুন, সে ওপারে চলে গেল ঠিক ১৩ তারিখেই।’ বলতে বলতেই হাসান আল মামুনের কণ্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছিল। প্রিয় বন্ধু সোহেল আল মাসুমের অকালে চলে যাওয়া এখনো মানতে পারছেন না জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক এই অধিনায়ক। ১৩ অক্টোবর মাত্র ৪১ বছর বয়সেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন এক সময়ের সাড়া জাগানো লেফট ব্যাক মাসুম। মামুন ছিলেন রাইট ব্যাক। এক সময় দলের রক্ষণের দুই প্রান্ত সামলেছেন দুজন। সাবেক সহযোদ্ধাকে নিজ হাতে চিরনিদ্রায় শুইয়ে দিয়ে আসতে হয়েছে মামুনকে। বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো মামুনের কণ্ঠে হাহাকার, ‘চলে তো যেতে হবে সবাইকেই, তাই বলে এই বয়সে!’ নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আবির্ভাবেই বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিলেন মাসুম। দুর্দান্ত ফুটবল খেলে দ্রুত জিতে নিয়েছিলেন মানুষের মন। সেই সোহেল আল মাসুমের মৃত্যু বড় এক ধাক্কা হয়েই এল বাংলাদেশের ফুটবলে। এই প্রজন্মের অনেকের কাছে মাসুম হয়তো অচেনা। কিন্তু ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সময়কালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে যাঁদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল, প্রায় সবাই-ই একবাক্যে স্বীকার করবেন, কী এক অসাধারণ প্রতিভাবান ফুটবলারই না ছিলেন মাসুম! ১৯৯৫ সালে ঢাকার প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে সাড়া ফেলে দিয়েছিল ইয়ংমেন্স ক্লাব। আর এই রূপবদলের অন্যতম কারিগর ছিলেন মাসুম। মাসুমের মতোই এক ঝাঁক নতুন প্রতিভা নিয়ে সেবার ব্রাদার্স ও মুক্তিযোদ্ধার মতো দলকে পেছনে ফেলে ইয়ংমেন্স লিগ লড়াইয়ে তৃতীয় হয়েছিল। ওই মৌসুমের শিরোপাজয়ী আবাহনীও হেরে গিয়েছিল ইয়ংমেন্সের কাছে। ঢাকার ফুটবলে ‘ম্যারাডোনার নাপোলি’র রোমাঞ্চ এনে ছিল বলেই হয়তো এখনো ফুটবলপ্রেমীদের মনে গেঁথে আছে ইয়ংমেন্সের ওই মৌসুমের খেলা। আর সেই দলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় সোহেল আল মাসুমকে কি তাই ভোলা যায়! মামুন-মাসুম, নামের মতোই দুজনের দোস্তিটাও ছিল বেশ। সেই আলোচিত মৌসুমে না থাকলেও মামুনেরও উত্থান ইয়ংমেন্স দিয়েই। দুজনই ছিলেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) ছাত্র। ১৯৯০ সালে ডেনমার্কের ডানা কাপ আর সুইডেনের গোথিয়া কাপে শিরোপা জিতে সারা দেশে হইচই ফেলে দেওয়া বিকেএসপির অনূর্ধ্ব ১৪ দলে খেলেছেন দুজনই। এক সঙ্গে কত স্মৃতি! সেই সব পুরোনো স্মৃতি যেন বাঁধভাঙা স্রোতের মতো এসে হাজির হচ্ছে মামুনের মনের মোহনায়। দেশের জার্সিও মামুনের আগেই গায়ে উঠেছিল মাসুমের। ১৯৯০ সালে এশীয় যুব অনূর্ধ্ব ১৬ প্রতিযোগিতার বাছাইপর্বে খেলতে ব্যাংকক গিয়েছিলেন মাসুম। সেবার মালয়েশিয়াকে ৪-০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। থাইল্যান্ডের সঙ্গে ১-১ আর দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ২-২ গোলে ড্র করে কোচ আবদুর রহিমের বাংলাদেশ দেশে ফিরেছিল মাথা উঁচু করেই। জাতীয় দলে অবশ্য দুই বন্ধুরই অভিষেক একসঙ্গে। ১৯৯৫ সালে অভিষেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের প্রথম শিরোপাজয়ী দলের সদস্য হওয়ার গৌরব এই দুই বন্ধু বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছেন দীর্ঘকাল। মিয়ানমারের সেই চার জাতি প্রতিযোগিতার প্রতিটি ম্যাচেই জাতীয় দলের একাদশে ছিলেন মাসুম। জার্মান কোচ অটো ফিস্টার তাঁর মধ্যে দেখেছিলেন অনন্য প্রতিভার বিচ্ছুরণ। মামুনের কণ্ঠে অভিমানও, ‘মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়, মাসুম ছিল প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভা। পায়ে ছিল দুর্দান্ত সব কাজ। সঙ্গে ছিল অসম্ভব গতি। কিন্তু ও ছিল প্রচণ্ড খামখেয়ালিও। ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারের চার জাতি প্রতিযোগিতায় মাসুমকে কোচ ফিস্টার লেফট উইং ব্যাকে প্রতিটি ম্যাচেই খেলিয়েছিলেন। অথচ সে সময় মাসুদ ভাইকে (মাসুদ রানা) দেশের সেরা লেফট ব্যাক হিসেবে মনে করা হতো। মাসুমের দাপটে মাসুদ ভাইকেও জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। একজন কোচ তখনই ফর্মে থাকা অভিজ্ঞ একজনকে সরিয়ে নবীনের ওপর আস্থা রাখেন, যখন তিনি জানেন, এই নবীন আস্থার প্রতিদান দেবে।’ মাসুম দিয়েছিলেনও। যদিও ধূমকেতুর মতো এসে ধূমকেতুর মতোই হারিয়ে গেছেন। চোটও ভুগিয়েছে। ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে হাঁটুতে একটা সমস্যা ছিল। কিন্তু খামখেয়ালি মাসুম সেটির চিকিৎ​সাও করাননি ঠিকমতো। চোটগ্রস্ত হওয়ার পর ফিরে আসার জন্য যে কঠোর পরিশ্রম করতে হ​য়, তাতেও অবহেলা ছিল বলে অকালে এক প্রতিভাকে হারিয়েছে বাংলাদেশের ফুটবল। ২০০০ সালের দিকে, মাত্র ২৬ বছর বয়সেই ক্যারিয়ার শেষ! বিদায় নেওয়ার খুব তাড়া ছিল বলেই হয়তো এত সাত তাড়াতাড়ি বিদায় নিলেন জীবনের ‘মাঠ’ থেকেও! মামুনকে প্রতিনিয়ত পীড়িত করছে মাসুমের স্মৃতি। অসংখ্য স্মৃতি! মাঠের স্মৃতি, মাঠের বাইরের স্মৃতি! যে ১৩ নম্বর জার্সি ‘অপয়া’ ভেবে কেউ নিতে চাইত না, সেই ১৩ নম্বরকেই যে খেলোয়াড়টি ‘পয়া’ প্রমাণ করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর দিন কিনা হলো ওই ১৩ তারিখ! জীবন আসলে এভাবেই নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে! মামুনের কণ্ঠে অসহায় আর্তি, ‘এভাবে চলে যেতে নেই বন্ধু, এভাবে চলে যেতে হয় না।’

অন্যরকম