খোলা বাজার২৪ ॥ বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর ২০১৫: রংপুরে জাপানের নাগরিক কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডে এক বিএনপি নেতার জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, নিহত কুনিওর ব্যবসায়িক সহযোগী গ্রেপ্তার করা হুমায়ুন কবির ওরফে হীরা গতকাল বুধবার রংপুরের আমলি আদালতে এ হত্যায় জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে বিএনপি নেতা হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের নামও এসেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
৩ অক্টোবর রংপুর শহরের উপকণ্ঠে কাচু আলুটারি গ্রামে দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন কুনিও হোশি। হত্যাকাণ্ডের পরপরই রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে হুমায়ুনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। হুমায়ুন কুনিওর ব্যবসায়িক সহযোগী। যাঁর মাধ্যমে কুনিও রংপুরে এসেছিলেন, সেই জাপানপ্রবাসী জাকারিয়া জামিল বলেছিলেন, তিনি হুমায়ুনকে অনুরোধ করেছিলেন কুনিওকে সহায়তা করার জন্য। হুমায়ুনকে তাঁরা অনেক দিন ধরেই চেনেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলেছে, দুই দফায় হুমায়ুনকে ২৫ দিন রিমান্ডে নেওয়ার পর গতকাল তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। কুনিও হত্যা মামলায় প্রথম দফায় ৫ থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত রিমান্ডে ছিলেন হুমায়ুন। এরপর একই মামলায় ১৪ অক্টোবর থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাঁকে। ১৯ অক্টোবর রংপুর শহরের ধাপ এলাকায় গত ১৫ জুলাই র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই ভাই মানিক ও সুমন নিহত হওয়ার ঘটনার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কোতোয়ালি থানার পুলিশ হুমায়ুনকে রিমান্ডে নেয়।
জেলা পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রগুলো বলেছে, গতকাল সন্ধ্যার পর হুমায়ুনকে কাউনিয়া আমলি আদালতে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি হাকিম শফিউল আলমের সামনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে হুমায়ুন তাঁর ভাই কামালের সঙ্গে বিএনপির নেতা হাবিব-উন নবীর যোগাযোগের কথা বলেছেন। তাঁরা পরস্পর যোগসাজশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন ও হুমায়ুন বিষয়টি আগে থেকেই জানতেন বলে স্বীকার করেছেন।
এ বিষয়ে রংপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) আবদুর রাজ্জাক বলেন, হুমায়ুন কবীরের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার বিষয়ে তিনি এখনো কিছু জানেন না।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবর উদ্ধৃত করে এসপিকে জানানো হয়, হুমায়ুন তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে এক বিএনপি নেতার যোগাযোগ ছিল। এটুকু বলার পরই এসপি আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমি কিছু জানি না। আপনারা যদি জেনে থাকেন, সেখানে আমার বলার কিছু নেই।’
এদিকে হুমায়ুনের স্ত্রী পারভীন খাতুন এর আগে বলেছিলেন, ৩ অক্টোবর ব্যবসায়িক সহযোগীর গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা শুনে বাসা থেকে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন হুমায়ুন। এরপর হুমায়ুন আর বাড়ি ফেরেননি। তাঁর সঙ্গে কোনো স্বজনকে দেখাও করতে দেওয়া হয়নি। ৫ অক্টোবর তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হয়। পারভীনের অভিযোগ, গ্রেপ্তার দেখানোর আগেই তাঁকে নির্যাতন করা হয়।
গতকাল দুপুরে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, হুমায়ুন কবির ও তাঁর শ্যালকের ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ টাকা লেনদেনের বিষয়টি গুরুত্বসহ দেখা হচ্ছে। বিদেশ থেকে টাকা পাঠিয়ে রাজনৈতিকভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করা ওই শ্যালককে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
কর্মকর্তারা বলেন, হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ও যে রিকশায় কুনিও খামারে যেতেন, সেই রিকশার চালক মুন্নাফ আলী এবং যে বাড়ির সামনে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ওই বাড়ির ছেলে মুরাদ হোসেনকে সন্দেহভাজন হত্যাকারীদের কিছু ছবি দেখানো হয়েছে। তাঁরা ছবি দেখে কাউকে চিহ্নিত করতে পারেননি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের গঠিত তদন্ত দলের প্রধান ও পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হুমায়ুন কবির বলেন, কোনো ব্যবসায়িক বিরোধে এই খুন হয়নি, এটা নিশ্চিত। খুব ঠান্ডা মাথায় হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এখানে গুলির অগ্রভাগের একটি অংশ ছাড়া দৃশ্যমান আলামত তেমন পাওয়া যায়নি। গুলির পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। তবে ওই প্রতিবেদন এখনো হাতে আসেনি।
কাউনিয়া থানার পুলিশ বলেছে, কুনিও হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত হুমায়ুনসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই দুজনের মধ্যে অন্যজন মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ-উন-নবী খান ওরফে বিপ্লবকেও ৫ অক্টোবর ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। তবে ১০ অক্টোবর তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। রাশেদ-উন-নবী বিএনপি নেতা হাবিব-উন-নবীর ভাই।
ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলা হত্যার ২৮ দিনের মাথায় ২৬ অক্টোবর এর রহস্য উন্মোচনের কথা বলেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ওই ঘটনায় একটি মোটরসাইকেলসহ চারজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পুলিশ বলেছে, এক ‘বড় ভাইয়ে’র নির্দেশে তাঁরা তাবেলাকে হত্যা করেছেন। দেশকে অস্থিতিশীল করাই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। এই হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা ওই চারজনের মধ্যে তামজিদ আহমেদ ওরফে রুবেল সেদিনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ২৭ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সেই নির্দেশদাতা ‘বড় ভাই’ হলেন বিএনপি নেতা ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আবদুল কাইয়ুম।
জাপানি নাগরিক কুনিও হত্যার ২৫ দিনের মাথায় গতকাল একজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন। যদিও এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র বা মোটরসাইকেল উদ্ধারের কথা জানায়নি পুলিশ।