Sat. May 3rd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খোলা বাজার২৪ ॥ শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর ২০১৫: ২৩ অক্টেবর শুক্রবার মধ্যরাতে হোসেনী দালানে বোমা 13বিস্ফোরণের ঘটনার দিন নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং এ ঘটনার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে বার বারই প্রশ্ন উঠছে। কারণ হোসনী দালানের পশ্চিম দিকে যে কবরস্থান থেকে দুর্বৃত্তরা বোমা ছুড়েছে সে কবরস্থানই সিসি টিভি ক্যামেরার আওতায় ছিল না। এমনকি কবরস্থানে কোনো আলোর ব্যবস্থা ছিল না।
হোসনী দালানের পুরো এলাকা আলো দিয়ে সজ্জিত করা হয়। তবে কবরস্থানে পৃথক কোনো আলোর ব্যবস্থা করা হয়নি কেবল বাইরে যে আলো জ্বলছিল তা আবছাভাবে কবরস্থানে পড়ছিল। সে আলোতে ঠিকভাবে খেয়াল না করলে বোঝার উপায় ছিল না যে সেখানে কেউ আছে কিনা। তারপরও হোসনী দালানের সামনের দিকে যে দু’টি সিসি টিভি ক্যামেরা ছিল তার একটিতে কবরস্থানের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছিল। ওই ক্যামেরাতেই হামলাকারী দু’জনকে দেখা যায়। তারা সাদা কুর্তা ও জিন্স পরিহিত ছিলেন। তাদেরই এখন খুঁজছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘হোসনী দালানের পশ্চিম দিকের কবরস্থানের উত্তর-পশ্চিম কোণে সাদা কুর্তা ও জিন্স পরিহিত একজন তিনটি গ্রেনেড ছুড়েছেন এমন দৃশ্য ওই সিসি টিভি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে। তবে কবরস্থানে পর্যাপ্ত আলো না থাকায় তার চেহারা ঠিকভাবে বোঝা যাচ্ছে না। যিনি গ্রেনেড ছুঁড়ছিলেন তার মতো পোশাক পরা আরেকজন পাশেই ছিলেন। তাদের টার্গেট ছিল বেশী জনসমাগম যেদিকে হয়েছে সেদিকে। এ জন্য দালানের উত্তর দিকে যেখানে ঘোড়াকে (দুল্দুল্) দুধ দিয়ে গোসল করানো হচ্ছিল এবং অনেকে তাদের সন্তানকে নিয়ে আসছিলেন মানত করার জন্য, সেখানেই প্রথম বোমাটি ছুড়েছে দুর্বৃত্তরা। প্রথমটি বিস্ফোরিত হওয়ার পর জনসমাগম দেখে দ্বিতীয় বোমাটি ছুঁড়ে মারা হয়। এরপর পালানোর সময় আরেকটি বোমা ছুঁড়ে মারে সাদা কুর্তা ও জিন্স পরিহিত ওই দুর্বৃত্ত। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যজন তাকে বোমা এগিয়ে দিয়ে ছুঁড়ে মারতে সাহায্য করছিল। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই এ ঘটনাটি ঘটে।
র‍্যাব-১০ এর অধিনায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর জানান, সাদা জামা পরিহিত দুইজন দুর্বৃত্ত পশ্চিম দিকে কবরস্থান থেকে তিনটি গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে। পরে তারা কবরস্থানের দেয়াল ঘেঁষে অন্ধকারে সীমানা টপকে পালিয়ে যায়। কবরস্থানের যে দিকের সীমানার দেয়াল একটু নিচু সেখানকার পানির পাইপটি ভাঙ্গা অবস্থায় পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, দেয়াল টপকানোর সময় পানির পাইপটি ভেঙ্গে ফেলে দুর্বৃত্তরা।
“আমরা হোসেনী দালান কর্তৃপক্ষের প্রধানের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, ‘কবরস্থানের ওই পানির পাইপটি রাতের আগে ঠিক ছিল, পানিও যাচ্ছিল। কিন্তু সকালে তা ভাঙ্গা পাওয়া যায়।’ ভাঙ্গা পাইপের দেয়ালের নিচে পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে।” বললেন র‍্যাব-১০ অধিনায়ক।
তিনি আরও বলেন, ‘এ পর্যন্ত যাদের সন্দেহজনকভাবে আটক করা হয়েছেতাদের কাছ থেকে তেমন কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি। ওইদিন তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয়। কিন্তু এ ঘটনার সঙ্গে এখনও তাদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
এদিকে, গোয়েন্দা একটি সূত্রে জানা যায়, যেহেতু বোমাগুলো হাতে বানানো ও বেশী শক্তিশালী ছিল না, তাই দুর্বৃত্তদের টার্গেট ছিল জনসমাগম এলাকা। পুরো হোসেনী দালান এলাকার নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণের জন্য ৩২টি সিসি টিভি ক্যামেরা বসানো হলেও কবরস্থান সে আওতায় ছিল না। কবরস্থানে ছিল না আলোর ব্যবস্থা। একটি ক্যামেরায় হামলাকারীদের মধ্যে দু’জনকে দেখা গেলেও তাদের সহযোগীদের অন্যকোনো ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়নি। এ ধরনের ঘটনায় সাধারণত দু’জন অপারেশনে আসে না। তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। পাঁচজন থাকার ব্যাপারে তথ্য পাওয়া গেছে। বোমা বিস্ফোরণের আগে মধ্যরাতের দিকে কামরাঙ্গীর চর এলাকা থেকে একটি মিছিল হোসেনী দালানে ঢোকে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই মিছিলের সঙ্গেই হামলাকারীরা দালানের ভেতরে প্রবেশ করে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মারুফ হাসান বলেন, ‘আমাদের কাছে আগে থেকেই গোয়েন্দা তথ্য ছিল, নিরাপত্তার মধ্যেও হামলা হতে পারে। পৃথিবীর অন্যদেশগুলোতে দেখা যায় ব্যাপক নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও হামলা হচ্ছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরাও ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। ঘটনাটি কীভাবে-কেন ঘটল, এ ছাড়াও ঘটনাস্থলে থাকা অন্য পুলিশ সদস্যদের কোনো গাফিলতি ছিল কি-না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাজিয়া মিছিলে হামলার গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এ জন্য রাতে তাজিয়া মিছিল বের না করতে অনুরোধও করা হয়। মিছিলের জন্য ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু হামলাটি হয় হোসেনী দালানের ভেতর থেকে। দুই থেকে পাঁচজন এ হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। ঘটনাস্থল থেকে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজসহ অন্যান্য আলামত সংগ্রহ করে তদন্ত করছে পুলিশ। হামলার ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটিকে এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব না হলে সময় বাড়িয়ে নেওয়া হবে।’
ঘটনার তদন্তে নিয়োজিত আরেকজন তদন্ত কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক হাজার ৭০০ সদস্য দায়িত্ব পালনে জন্য ওইদিন রাখা হয়। কার, কখন দায়িত্ব ছিল তা এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কেউ দায়িত্বে অবহেলা করেছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। হামলার কথা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগে থেকে আভাস পেলেও তারা ধারণা করেছিল তাজিয়া মিছিলের সময় হামলা হতে পারে। কিন্তু হোসেনী দালানের ভেতরে হামলা হবে এটা কেউই চিন্তা করতে পারেনি।’
ডিএমপির গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের (ডিবি) উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, ‘পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল সেদিন। ছাদেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন। হামলার পর আমরা তাৎক্ষণিকভাবে মনে করি পিন খুলে হয়ত বোমাটি রেখে যাওয়া হয়। কিন্তু পরে ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় বোমাটি গ্রেনেডের মতো ছুঁড়ে মারা হয়েছে। একজন ছুঁড়ে মারে এবং তার পাশে আরেকজনকে দেখা যায়। বেশকিছু ব্যাপার পর্যালোচনা করে তদন্ত করা হচ্ছে। ফুটেজ দেখে অপরাধী শনাক্তের চেষ্টা চলছে। যারা বোমা ছুঁড়ে মেরেছে তারা দু’জন ছিল এবং কুর্তা অথবা পাঞ্জাবি পরিহিত ছিল।’
২৩ অক্টোবর শুক্রবার মধ্যরাতে পুরান ঢাকার লালবাগে হোসেনী দালানের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় তিনটি হাতে তৈরি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। এতে শতাধিক লোক আহত হন। নিহত হন কেরানীগঞ্জের নাসির উদ্দীনের ছেলে সাজ্জাদুল হক সানজু (১৬) নামের এক কিশোর। এদিকে গুরুতর আহত রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারের রিয়াজউদ্দীন রোডের জামাল উদ্দিন (৫০) বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।