খোলা বাজার২৪ ॥ শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর ২০১৫: সপ্তাহের শেষ দিন আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে এক মার্কিন ডলারের জন্য ৭৭ টাকা ৮৩ পয়সা খরচ করতে হয়েছিল। এই সপ্তাহের শেষ দিন প্রতি ডলারের জন্য ২০ পয়সা বেশি গুণতে হয়েছে।
এই সপ্তাহের চার দিনের প্রতিদিন ৫ পয়সা করে কমেছে টাকার মান। তার মানে শক্তিশালী হচ্ছে ডলার। কার্ব মার্কেটে ডলারের দর উঠেছে ৮২ টাকা পর্যন্ত।
প্রায় নয় মাস ৭৭ টাকা ৮০ পয়সায় স্থির থাকার পর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার একটু ‘নড়াচড়া’ শুরু করে। এখন প্রতিদিনই কমছে টাকার মান।
রপ্তানি আয় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে কিছুটা ভাটা পড়ায় বাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়াকে ডলারের দাম বাড়ার কারণ দেখাচ্ছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুর রহমান।
টাকা দুর্বল হওয়ার এই ধারা অব্যাহত থাকতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কর্মকর্তা।
তবে টাকার মান কমার এই প্রবণতা রেমিটেন্স ও রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত।
তিনি বলেন,“বাজার থেকে ডলার কিনে এক ধরনের হস্তক্ষেপ করে এতদিন ডলার-টাকার বিনিময় হার স্থির রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কেউ আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করছে না।
“দাম আরও বাড়তে পারে-সে আশায় সবাই ডলার আটকে রাখছে। আর সে কারণেই দাম বাড়ছে।”
হঠাৎ করে ডলারের চাহিদা কেন বেড়েছে- এ প্রশ্নের উত্তরে বি আইডিএসের এই গবেষক বলেন, আমদানি বেড়েছে। সরকারের বড় বড় প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানির এলসি খোলা হচ্ছে।
“এছাড়া ডলার ছাড়া অন্যান্য দেশের মুদ্রার মান পড়ে যাওয়ায় রপ্তানি আয়ও কম আসছে। রেমিটেন্স প্রবাহেও ধীর গতি। সবকিছু মিলিয়েই বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়েছে।”
তবে এতে উদ্বেগের কোনো কারণ দেখছেন না জায়েদ বখত।
“প্রচুর রিজার্ভ আছে। কোনো অসুবিধা হবে না; বরং রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সের জন্য ভালো হবে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন বৃহস্পতিবারই ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে প্রথম বারের মতো।
এই রিজার্ভ নিয়ে গভর্নর আতিউর রহমান সন্তুষ্ট হলেও তা উৎপাদনশীল খাতে ‘কাজে আসছে না’ বলে অনেক অর্থনীতিবিদ তা নিয়ে অতটা উচ্ছ্বসিত নন।
জায়েদ বখত মনে করেন, বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতে ডলারের বিপরীতে টাকা দুর্বল হওয়া দরকার।
চলতি অক্টোবর মাসের ২৩ দিনে (১ অক্টোবর থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত) ৮২ কোটি ১৭ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
তার আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ৩৯৩ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে। যা ছিল গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২ শতাংশ কম।
ডলার শক্তিশালী হওয়ায় আগে প্রবাস থেকে পাঠানো মুদ্রা ভাঙিয়ে যে টাকা পাওয়া যেত, এখন তার চেয়ে বেশি পাওয়া যাবে। আবার পণ্য রপ্তানি করে পাওয়া ডলারের বাংলাদেশি টাকায় মূল্যমানও হবে বেশি।
টাকা শক্তিশালী থাকা অবস্থায় রপ্তানিকারকদের তুলনায় আমদানিকারকরা বেশি লাভবান হচ্ছিলেন। কারণ টাকার মূল্যে হিসাব করলে সব পণ্যের আমদানি খরচ কম পড়ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১২ সালে ডলারের দর বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে ৮৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। তখন এক ডলার কিনতে ৮৫ টাকা লাগত।
গত তিন বছরে সেই ডলারের দর পড়তে পড়তে গত বছরের অগাস্টে ৭৭ টাকা ৪০ পয়সায় নেমে এসেছিল।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি ডলার ৭৭ টাকা ৮০ পয়সায় স্থির ছিল।
রপ্তানি বাড়াতে সম্প্রতি চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়না চীনা মুদ্রা ইউয়ানের বিনিময়মূল্য বেশ খানিকটা কমিয়েছে।
বাংলাদেশে অর্থনীতিবিদরা রপ্তানি ও রেমিটেন্স বাড়াতে বিভিন্ন সময়ে টাকার মান কমানোর পরামর্শ দিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে সাড়া দেয়নি।
এখন সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুই সপ্তাহ ধরে বাজার থেকে কোনো ডলারও কিনছে না তারা।
এ প্রসঙ্গে ছাইদুর রহমান বলেন, “এখন আর কেউ ডলার বিক্রি করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসছে না। সর্বশেষ গত ১৩ অক্টোবর আমরা ডলার কিনেছিলাম।”
চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট ১৭৫ কোটি ( ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন) ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সবমিলিয়ে ৩৪০ কোটি (৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার আগের বছরে (২০১৩-১৪) কেনা হয় ৫১৫ কোটি ডলার।
২০০৩ সালে বাংলাদেশে ভাসমান মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা (ফ্লোটিং) চালু হয়। অর্থ্যাৎ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে টাকা-ডলারের বিনিময় হারে হস্তক্ষেপ করেছে।
তার আগ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার-টাকার বিনিময় হার ঠিক করে দিত। সে দরেই ডলার লেনদেন হত।