Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

8খোলা বাজার২৪ ॥ রবিবার, ১ নভেম্বর ২০১৫: নৃশংস জোড়া হামলা চালিয়ে ঢাকায় গতকাল শনিবার এক প্রকাশককে হত্যা এবং আরেক প্রকাশকসহ দুই কবি ও ব্লগারকে গুরুতর আহত করেছে দুর্বৃত্তরা। বেলা আড়াইটায় লালমাটিয়ায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়। সেখান থেকে তিনজনকে হাসপাতালে নিয়ে যখন চিকিৎসা চলছিল, তখন জানা গেল, শাহবাগে আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটে আরেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জাগৃতির কার্যালয়ের ভেতরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন প্রতিষ্ঠানের মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপন। দুটি ক্ষেত্রেই হামলার পর কার্যালয়ের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
ফয়সাল আরেফিনকে (৪৩) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত ফয়সালের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক আবুল কাসেম ফজলুল হক। ছেলে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ, হতাশ এই বাবা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি কোনো বিচার চাই না। আমি চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নিয়ে রাজনীতি করছেন, যাঁরা রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন, উভয় পক্ষ দেশের সর্বনাশ করছেন। উভয় পক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। এটুকুই আমার কামনা। জেল-ফাঁসি দিয়ে কী হবে।’
কারা এই খুনের সঙ্গে জড়িত জানতে চাইলে জাগৃতি কার্যালয়ের সামনে আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘বিষয়টা অত্যন্ত স্পষ্ট। লালমাটিয়ায় যারা হামলা করেছে, তারাই দীপনকে হত্যা করেছে। অভিজিৎ দীপনের বন্ধু ছিল। ওর বইও দীপন বের করেছে। তবে সে ধর্মের বিরুদ্ধে কখনো লেখেনি। কোনো উসকানিও দেয়নি। কখনো কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করেনি। কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতাও নেই।’
রাতে এই দুই হামলার দায় স্বীকার করেছে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাদেশ শাখা আনসার আল ইসলাম। নিজেদের টুইটার অ্যাকাউন্টে এই বিবৃতি দিয়ে এ দায় স্বীকার করা হয়।
এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক প্রবীণ অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে অভিজিৎ রায়কে একই কায়দায় হত্যা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) বাইরের ফুটপাতে। সেই হত্যায় জড়িত কাউকে আট মাসেও ধরতে পারেনি পুলিশ।
সন্তানের মরদেহ কাঁধে নেওয়ার তালিকায় গতকাল যুক্ত হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, এ ঘটনায় সরকার বিব্রত। তবে আগুন-সন্ত্রাস সরকার যেমন দমন করতে পেরেছে, তেমনি এ ধরনের নাশকতা ও পরিকল্পিত হত্যাও সরকার বন্ধ করবে।
পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ধারণা, চার ব্লগারের মধ্যে ঘাতকদের লক্ষ্য ছিল দুজন—ফয়সাল আরেফিন ও আহমেদুর রশীদ চৌধুরী (টুটুল)। এই দুজনই ছিলেন অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক, একই সঙ্গে বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার। একা থাকায় দীপন বাঁচতে পারেননি, আজিজ সুপার মার্কেটে নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ভেতর তাঁকে কুপিয়ে তালাবদ্ধ করে রেখে যায় ঘাতকেরা। আর লালমাটিয়ায় আহমেদুর রশীদ চৌধুরীকে হত্যা করতে গেলে তাঁর সঙ্গে থাকা দুই ব্লগার তারেক রহিম ও রণদীপম বসুকেও দুষ্কৃতকারীরা কুপিয়ে দরজা বন্ধ করে রেখে যায়। আহত অবস্থায় রণদীপম ফেসবুকে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানান। প্রতিষ্ঠানের ভেতরে আটকা পড়া একজন মুঠোফোনে হামলার বিষয়টি পুলিশের তেজগাঁও অঞ্চলের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারকে জানান। তারপর পুলিশ এসে আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে।
এর আগে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এবং ৩ অক্টোবর রংপুরে যথাক্রমে দুই বিদেশি নাগরিক সিজার তাবেলা ও কুনিও হোশিকে হত্যা, এরপর ৫ অক্টোবর ঢাকায় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকে হত্যা এবং পাবনার ঈশ্বরদীতে একজন ধর্মযাজককে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ২৩ অক্টোবর পবিত্র আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে হামলায় দুজন নিহত হয়। এসবের রেশ না কাটতেই গতকালের এই নৃশংস হামলার ঘটনা ঘটে।
পাঁচজন ব্লগারকে এর আগে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো ঘটনার বিচারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। নিহত ব্লগাররা হলেন আহমেদ রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ ও নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়। গত বছর ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল ব্লগার হত্যাকাণ্ড। তখন থেকে একটির পর একটি ঘটনা ঘটছে, আর আগের ঘটনা হারিয়ে যাচ্ছে বা ধামাচাপা পড়ছে।
এই পাঁচটি ঘটনার মধ্যে ৩০ মার্চ তেজগাঁওয়ের দক্ষিণ বেগুনবাড়ীতে প্রকাশ্যে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে হত্যা করে পালানোর সময় কয়েকজন হিজড়া এবং স্থানীয় লোকজন জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম নামের দুজনকে ধরে ফেলেন। এ ছাড়া আর কোনো ঘটনায় সরাসরি কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি রাজধানীর মিরপুরে নিজ বাড়ির সামনে আহমেদ রাজীব হায়দারকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার মামলায় জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানীসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
এ দুটি ঘটনার মধ্যে ধারাবাহিকতা ছাড়াও মৌলিক কিছু বিষয়ে মিল খুঁজে পাওয়া গেছে, যার সঙ্গে পুলিশ, নিহত ব্যক্তিদের পরিবার, মুক্তিযুদ্ধের লেখক, গবেষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ একমত প্রকাশ করেছেন। তা হলো জাগৃতি ও শুদ্ধস্বর—উভয় প্রকাশনা সংস্থা থেকেই অভিজিতের বই প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া ওই দুটি প্রকাশনা সংস্থা মুক্তচিন্তার লেখক, ব্লগার ও তরুণদের বই প্রকাশ করে থাকে।