Sat. May 3rd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

1
খোলা বাজার২৪ ॥বৃহস্পতিবার, ৫ নভেম্বর ২০১৫: অংযঁষরধ-ঢ়ড়ষরপবযড়ঃঃধসাভারের আশুলিয়ায় তল্লাশি চৌকিতে কনস্টেবলকে কুপিয়ে হত্যার সময় হামলাকারী তিনজন ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে।
বুধবার সকাল পৌনে ৮টার দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বাড়ইপাড়া এলাকায় পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালিয়ে একজনকে হত্যা এবং একজনকে জখম করে মোটর সাইকেলে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
ওই এলাকায় দায়িত্বরত শিল্প পুলিশ-১ এর উপপরিচালক কাওসার শিকদারের দাবি, অস্ত্র ছিনতাই করতে না পেরে কনস্টেবল মুকুল হোসেনকে ছুরিকাঘাত করে হামলাকারীরা।
তবে প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, তল্লাশি চৌকিতে মোটর সাইকেলটি থামানোর পরপরই আরোহীরা ছুরি-চাপাতি নিয়ে পুলিশের উপর হামলা চালায়।
হামলার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় ‍অতিরিক্ত আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাটি পরিকল্পিত বলেই তার মনে হচ্ছে।
“যারাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তারাই সবাই প্রশিক্ষিত।”
পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের এই কর্মকর্তা বলছেন, গত মাসে ঢাকার গাবতলীর হামলা এবং বাড়ইপাড়ার হামলা ‘একই সূত্রে গাঁথা’।
যুদ্ধাপরাধী দুই মন্ত্রীর বিচার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আগে সেপ্টেম্বরের শেষ এবং অক্টোবরের শুরুতে ঢাকা ও রংপুরে দুই বিদেশিকে হত্যার পর সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদার হয়, বিভিন্ন স্থানে চৌকি বসিয়ে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ।
এর মধ্যেই ২২ অক্টোবর রাজধানীর অন্যতম প্রবেশমুখ গাবতলীতে তল্লাশি চৌকিতে ছুরিকাঘাতে ইব্রাহিম মোল্লা নামে এক এএসআইকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
গাবতলীতে এএসআই ইব্রাহিমকে ছুরিকাঘাতকারী হেঁটে আসছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে দুই বিদেশি ঢাকায় চেজারে তাভেল্লা এবং রংপুরে কুনিও হোসিকে আক্রমণের সময় হামলাকারীরা তিনজন ছিলেন এবং মোটর সাইকেলে ছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে এসেছে।
দুই বিদেশিকে হত্যার সময় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হলেও পুলিশ হত্যাকাণ্ডের দুটি ক্ষেত্রেই ব্যবহার হয়েছে ছোরার মতো ধারাল অস্ত্র। তবে আশুলিয়ায় হামলাকারীরা পালানোর সময় তাদের সঙ্গে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছুড়েছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে।
হামলার কয়েক ঘণ্টা পর বাড়ইপাড়ার পুলিশ তল্লাশি চৌকিতে গিয়ে দেখা ছোপ ছোপ রক্ত। বিনোদন কেন্দ্র নন্দন পার্কের প্রধান ফটকের সামনের এই স্থানটি দিনের বেলায় সরগরম থাকলেও সকালে সেরকম অবস্থা থাকে না, রাতে এলাকাটি থাকে সুনসান।
সেখানে ছিনতাই ঠেকাতে কয়েক মাস ধরে আশুলিয়া থানা পুলিশ রাতে-দিনে তল্লাশি চৌকি বসিয়ে সন্দেহজনক যানবাহনে তল্লাশি চালাচ্ছিল।
এর আশপাশের আধা কিলোমিটারের মধ্যে জনবসতি বেশ কম। ঘটনাস্থল থেকে অন্তত ২০০ গজ পূর্ব পাশে কয়েকটি ঘর রয়েছে গজারী বনের ভেতরে। সেখানে বিভিন্ন শ্রমিকরা থাকেন।
ঢাকা জেলার সহকারী পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান কিরণ জানান, সকাল পৌনে ৮টার দিকে চেকপোস্টে হামলা হয়। এতে ছুরিকাহত হন কনস্টেবল মুকুল হোসেন ও নুরে আলম সিদ্দিক।
হাসপাতালে নেওয়া হলে মুকুলের মৃত্যু হয়। তল্লাশি চৌকিতে কর্তব্যরত বাকি তিন পুলিশ কনস্টেবলও আহত হন বলে পুলিশ জানিয়েছে।
শিল্প পুলিশ-১ এর উপ-পরিচালক কাওসার বলেন, “কয়েকটি মোটর সাইকেলে করে এসে ৭/৮ জন দুর্বৃত্ত অতর্কিত হামলা চালায়।”
প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, একটি মোটর সাইকেলে চড়ে কালিয়াকৈরের দিক থেকে আসা তিন যুবক হামলা চালিয়েছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক বলেন, “চেকপোস্টের কাছে মোটর সাইকেলটি এলে পুলিশ থামার সিগনাল দেয়। মোটর সাইকেলটি থামার পর পুলিশ এর কাছে যাওয়া মাত্র ওই তিন যুবক কনস্টেবল মুকুল ও নুর আলমকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে।
“আহত অবস্থায় ওই দুই পুলিশ সদস্য দৌড়ে মহাসড়কের পাশের শুভেচ্ছা হোটেলে ঢুকে পড়ে। সেখানে গিয়েও তাদের কোপায় দুই যুবক। এরপর তারা গজারি বনের ভেতরে ঢুকে পড়ে। তখন ভয়ে আমি সেখান থেকে চলে আসি।”
এই যুবক জানান, মোটর সাইকেলে থাকা তিনজনের বয়স ৩০-৩৫ বছর হবে। এদের মধ্যে দুজন হেলমেট পরা অবস্থায় ছিল। একজনের কাছে একটি ব্যাগ ছিল, তার ভেতর থেকে ধারাল অস্ত্র দুটি বের করে তারা।
ঘটনাস্থলের পাশের এক চা দোকানি আরেকটি মোটর সাইকেলে দুই যুবককে দেখার কথা জানিয়েছেন। তবে ওই দুই যুবক হামলায় অংশ নেননি।
তিনি বলেন, গজারী বন থেকে বেরিয়ে ফাঁকা গুলি করে একটি মেরুন এবং কালো রংয়ের মোটর সাইকেলে চড়ে হামলাকারীরা নবীনগরের দিকে চলে যায়।
শিল্প পুলিশের পরিদর্শক মো. নাসিম বলেন, “ধারণা করা হচ্ছে, তিন থেকে চার মিনিটের মধ্যেই ঘটনা ঘটে গেছে। একটি মোটর সাইকেলে হামলাকারীরা এলেও অন্য মোটর সাইকেলটি সেখানে ওঁৎ পেতে ছিল।”
হামলাকারী ৩, পুলিশ ৫
তল্লাশি চৌকিতে হামলার সময় পাঁচজন সশস্ত্র কনস্টেবল থাকলেও তিনজনের হামলায় তারা কুপোকাৎ হন প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে এসেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও বলেছেন, কনস্টেবল মুকুল ও নুর আক্রান্ত হলে তার অন্য তিন সহকর্মী পালিয়ে যান গজারি বনের দিকে। তখন একজন ড্রেনে পড়ে আহতও হন।
স্থানীয়রাই একটি রিকশা ভ্যানে করে কনস্টেবল মুকুল ও নুরকে কাছের ফাতেমা ক্লিনিকে নিয়ে যান। সেখান থেকে আশুলিয়া থানা পুলিশ ও শিল্প পুলিশ অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মুকুলকে মৃত ঘোষণা করেন।
স্থানীয়রা বলছেন, সহকর্মীরা তাৎক্ষণিকভাবে দুই কনস্টেবলকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মুকুলকে বাঁচানো যেত।
এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক এস এম রফিকুল ইসলাম জানান, মুকুলের বুকে, পিঠে, মুখে, গলায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের জখম রয়েছে। তাকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে।
এছাড়া নুর আলমের পেটে, মুখে ও বুকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তার অবস্থাও গুরুতর বলে জানান ডা. রফিকুল।
চৌকিতে কর্তব্যরত অন্য তিন পুলিশ কনস্টেবল হলেন পিনহারুল ইসলাম, ইমরান আজিজ ও আপেল মাহমুদ। এদের মধ্যে পিনহারুল নর্দমায় পড়ে যান।
“গজারি বনের দিকে দৌড়ে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তদের একজন চাপাতি উঁচু করে তাদের (পুলিশ) ধাওয়া দেয়,” বলেন প্রত্যক্ষদর্শী একজন।
আহতদের সঙ্গে সাংবাদিকদের কথা বলতে দেননি পুলিশ কর্মকর্তারা। ঢাকা জেলার সহকারী পুলিশ সুপার নাজমুল বলেন, ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এনাম মেডিকেল কলেজে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এনাম মেডিকেলে হতাহতদের দেখতে এসে সাংবাদিকদের বলেন, “পুলিশ গুলি চালাল না কেন, তা তদন্ত করতে আইজিপিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
ঘটনার সময় আশুলিয়া থানার এসআই একরাম হোসেনের দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও তখন তিনি সেখানে ছিলেন না বলে জানিয়েছেন শিল্প পুলিশের এসআই জাকির হোসেন।
এদিকে এই ঘটনার পর আশুলিয়া থানার এসআই হাবিবুর রহমানকে ঢাকা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। ঘটনাস্থল তার দায়িত্বের এলাকায় ছিল।
এএসপি নাজমুল বলেন, “পুলিশ সদস্যদের বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তাদের কোনো গাফিলতি বা অন্য কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
পুলিশের উপর হামলাস্থল অতিরিক্ত আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী ছাড়াও উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিদর্শন করেছেন। দুপুরে ঘটনাস্থলে যান র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ।
সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছু আলামত সংগ্রহ করেছে। উদ্ধার করেছে দুটি গুলির খোসাও।
আইজিপি বিদেশে থাকায় পুলিশ প্রধানের দায়িত্বে থাকা জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, এই হামলার পর সারা দেশে তল্লাশি চৌকিগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
মুকুল ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম
ছুরিকাঘাতে নিহত পুলিশ কনস্টেবল মুকুলের বাড়িতে শোকের মাতম চলছে বলে বগুড়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন।
বগুড়ার শিবগঞ্জে রহবল পূর্বপাড়া গ্রামের শহিদুল ইসলামের চার ছেলে-মেয়ের একজন মুকুল।
শহিদুল বিলাপ করতে করতে বলেছিলেন, “আমার সোনার ধন মুকুল। তোকে ছাড়া আমি কীভাবে বাঁচব।”
ছোট ভাই জিসান বলেন, মুকুলই ছিল তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
জিসান উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে, বোন শম্পা নবম শ্রেণিতে ও ছোট বোন মিষ্টি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।
“ভাই সব সময় বলত, লেখাপড়া করে অনেক বড় হতে হবে। সেই আমাদের পড়ালেখাসহ পরিবারের খরচ দিত,” বলেন জিসান।
ভাগ্নের লাশ নিতে সাভারে গিয়ে আব্দুল কুদ্দুস বলেন, “সে ছিল পরিবারের একমাত্র ভরসা। তার বেতনের টাকার সংসার চলত। পরিবারটি একেবারে ভেঙে পড়েছে।”
শিবগঞ্জ থানার ওসি এসএম আহসান হাবীব মুকুলের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারকে সান্ত্বনা জানান।
তিনি জানান, লাশ আনার পর বৃহস্পতিবার সকালে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে মুকুলকে।
২০১২ সালে কনস্টেবল হিসেবে পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন মুকুল। শিল্প পুলিশের আশুলিয়া জোনে দায়িত্ব দেওয়ার হয় তাকে।
আহত কনস্টেবল নুর আলমের বাড়ি শেরপুর জেলার শ্রীবরদী থানার কুড়িকাহন গ্রামে। ওই গ্রামের আবদুল বারীর ছেলে নুর ২০১৪ সালে পুলিশে যোগ দেন।