খোলা বাজার২৪ ॥ রবিবার ৮ নভেম্বর ২০১৫: আড়াই দশক পর প্রথমবারের মতো সব দলের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিচ্ছে মিয়ানমারের জনগণ, যার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হবে দীর্ঘ দিন ধরে সেনা কর্তৃত্বের নিচে থাকা এ দেশটির রাজনৈতিক ভবিষ্যত।
স্থানীয় সময় রোববার সকাল ৬টায় থেকে শুরু হয়েছে ভোট। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে লাইন ধরে ভোটাররা ভোট দিচ্ছেন। বিরতিহীনভাবে এই ভোট চলবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত।
এই নির্বাচনে ৯২টি দল অংশ নিলেও সেনা সমর্থিত ক্ষমতাসীন দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেমোক্রেটিক পার্টি ও (ইউএসডিপি) অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) মধ্যেই যে মূল লড়াই হবে, তা স্থানীয়দের কথায় স্পষ্ট।
যে তালিকায় এ ভোট হচ্ছে, তাতে ভোটার রয়েছেন প্রায় তিন কোটি। তাদের ভোটে ৪৪০ আসনের পার্লামেন্ট ‘পিথু হালতাউয়ের’ (প্রতিনিধি পরিষদ) ৩৩০ জন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। বাকি ১১০ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত।
সাড়ে পাঁচ দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা সেনাবাহিনী সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে এমন সব বিধান চালু করেছে যেগুলো পেরিয়ে ক্ষমতায় আসা যে কোনো দলের জন্যই কঠিন। সংবিধান সংশোধনের জন্য তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের সমর্থন লাগবে। ফলে সব বেসামরিক এমপি একজোট হলেও সংবিধান সংশোধন সম্ভব হবে না সেনাবাহিনীর সদস্যদের সমর্থন ছাড়া।
২০০৮ সালে মিয়ানমারের সংবিধান সংশোধনের সময় রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন, সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতার অংশদারিত্ব প্রদান, পার্লামেন্টে তাদের জন্য ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষণসহ বেশ কিছু ধারা সংযোজন করা হয়, যেগুলোকে ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে আসছেন এনএলডির নেতারা।
সংবিধানে প্রেসিডেন্টই সর্বময় ক্ষমতার উৎস। আবার প্রেসিডেন্টকে সেনাবাহিনীর পরামর্শ নিয়ে কাজ করতে হয়। পার্লামেন্টে পাস করা যে কোনো আইনে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে তার।
বিদেশিকে বিয়ে করায় সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথও বন্ধ হয়েছে ওই সংবিধানে। সংবিধানের ৫৯ (এফ) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোনো বিদেশি নাগরিককে বিয়ে করেন এবং তার সন্তানরা অন্য দেশের নাগরিক হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
অবশ্য নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হলে ক্ষমতার পালাবদলের সমীকরণ মেলানোর কঠিন দায়িত্বটি এনএলডি চেয়ারপারসনের হাতেই পড়ছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা।
শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চি সকাল সাড়ে ৭টায় ইয়াঙ্গুনের বাহাম টাউনশিপের একটি কেন্দ্রে ভোট দেন। কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে হাসি মুখে তাকে গাড়িতে উঠতে দেখা যায়।
সকালে ইয়াঙ্গুনের ডাউন টাউন, বাহাম টাউনশিপ, ইয়াকতাদা টাউনশিপের ১১টি কেন্দ্রে ঘুরে ভোটারদের ভালো উপস্থিতি দেখা যায়। নারী ভোটারদের মধ্যেও ভোট নিয়ে ছিল ব্যাপক আগ্রহ।
ডাউন টাউনের বাণিজ্যিক এলাকার একটি কেন্দ্রে কথা হয় অ্যানি সুই নামের এক তরুণীর সঙ্গে। তিনি বলেন, “এই প্রথম ভোট দিচ্ছি। ভালো লাগছে।”
কেন্দ্রের সামনে ভোটার তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। তালিকায় নাম খুঁজতে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না তাদের।
ভোটকেন্দ্রের বাইরে বা আশপাশে দলীয় প্রার্থীদের লোকজনকে দেখা যায়নি। ভোটাররা ভোট দিয়ে বেরিয়ে এসে আঙুলে অমোচনীয় কালির চিহ্ন দেখাচ্ছেন সাংবাদিকদের।
ভোট উপলক্ষে দোকান-পাঠ-বিপনী বিতানসহ সরকারি অফিস বন্ধ রয়েছে। তবে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক। পুলিশের সাদা গাড়ি সড়কগুলোকে টহল দিচ্ছে।
৭৮ বছর বয়সী অ্যামী নাইং সুই সকাল সাড়ে ৭টায় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ইয়াঙ্গুনের পাজুনডা টাউনশিপের এনাওয়াদা সড়কের একটি কেন্দ্র ভোট দিতে আসেন।
ভোট দিয়ে বেরিয়ে তিনি বলেন, “ভোট দিতে এসেছি, গণতন্ত্রের জন্য। সারা শহর জুড়ে মেয়েরা ভোট কেন্দ্রে লাইনে আছে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে! রাস্তায় স্বাধীন অসংখ্য কবুতর আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে- দেখুন।”
বেশ কিছু ভোট কেন্দ্রের সামনে পুলিশের গাড়ির পাশপাশি দমকলের গাড়িও দেখা গেছে। পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি লুঙ্গি পরা সাদা পোশাকের পুলিশও রয়েছে ওয়্যারলেস হাতে।
এনএলডি ও ইউএসডিপি ছাড়াও মিয়ানমারস ফারমার্স ডেভেলপমেন্ট পার্টি, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফোর্স (এনডিএফ), ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টিসহ (এনইউপি) নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের ৯২টি দলের ৭ হাজার প্রার্থী এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন।
ইউনিয়ন নির্বাচন কমিশন বলছে, বন্যাকবলিত কয়েকটি অঞ্চলের কিছু কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত রাখা হয়েছে, বাকি সব জায়গায় ‘শান্তিপূর্ণ’ ভোট চলছে।
বিকালে ভোট শেষে শুরু হবে গণনার কাজ। ভোটের ফলাফল পেতে মিয়ানমারবাসীকে সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে।
ভোটের সকালেও স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো প্রথম পাতায় সু চির বড় বড় ছবিসহ বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আগের দিন ইয়াঙ্গুন, নেপিদো ও ডাউনটাউনের সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে,অধিকাংশই দেশের নেতৃত্বে অং সান সু চিকে দেখতে চান।
তবে সু চির দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সংবিধান অনুযায়ী এখনই ক্ষমতা হন্তান্তরের সুযোগ নেই। বর্তমান পার্লামেন্টের মেয়াদ (৫ বছর) ৩০ জানুয়ারি শেষ হওয়ার পরই নতুন নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে পার্লামেন্ট গঠন হবে।
প্রেসিডেন্ট থিয়েন শিয়েন অবশ্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনেরই প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন। ফলাফল যাই হোক, তাকে ‘সম্মান জানানোর’ আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
১৯৬২ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর সামরিক একনায়তন্ত্রের অধীনে ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল এনএলডি। সামরিক সরকার নির্বাচনী ফল প্রত্যাখ্যান করায় সে সময় ক্ষমতাগ্রহণ তো দূরে থাক, গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি মেলেনি সু চির।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে গৃহবন্দি সু চি ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পেলে এনএলডির জনপ্রিয়তা শীর্ষে উঠে আসে। ২০১২ সালের উপ-নির্বাচনে ৪৫টি আসনের মধ্যে ৪৩টিতে জয়ী হয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হয় তার দল।
এর আগে ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর পার্লামেন্ট নির্বাচন হলেও তাতে অংশ নেয়নি এনএলডি। এর ছয় দিনের মাথায় সু চি গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পান। এবার প্রথম থেকেই মুক্তভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পেরেছেন তিনি।