Sat. May 3rd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

1খোলা বাজার২৪ ॥শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর ২০১৫: আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে নারায়ণগঞ্জে নেওয়া হয়েছে। রাজধানী ঢাকার র‍্যাব-১ এর সদর দপ্তর থেকে আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নূর হোসেনকে আপাতত জেলা পুলিশ লাইনসে রাখা হয়েছে। পরে সেখান থেকে তাকে নারায়ণগঞ্জ বিচারিক হাকিম আদালতে তোলার কথা।
এর আগে র‍্যাব-১ এর কার্যালয় থেকে নূর হোসেনকে নিয়ে র‍্যাব-পুলিশের একটি গাড়িবহর নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়। পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের সাইনবোর্ড এলাকায় নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন নূর হোসেনকে গ্রহণ করে ওই গাড়িবহরসহ জেলা পুলিশ লাইনসে যান।
ওই গাড়িবহরের মধ্যে একটি সাদা রঙের প্রাইভেট কারে করে নূর হোসেনকে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও সাত খুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে নূর হোসেনকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কাছে হস্তান্তর করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। পরে র‍্যাব-পুলিশ তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসে। গত বুধবার বাংলাদেশের কারাগারে আটক উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে দুই সঙ্গীসহ ভারতে ফেরত পাঠানো হয়।
জানতে চাইলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, রাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) নূর হোসেনকে বিজিবির হাতে তুলে দেয়।
গত বছরের ২৭ এপ্রিল সাত খুনের পরে ভারতে পালিয়ে যান নূর হোসেন। ওই বছরের ১৪ জুন কলকাতার বাগুইআটিতে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ভারতে অবস্থানের মামলা হয়। গত মাসে ভারত সরকার সেই মামলা প্রত্যাহার করে নিলে নূর হোসেনের দেশে ফেরার পথ সুগম হয়।
কলকাতা প্রতিনিধি জানান, গতকাল ভারতের স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে কলকাতার দমদম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে নূর হোসেনকে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কর্মকর্তারা তাঁর নামে একটি পারমিট ইস্যু করে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাহায্যে কঠোর নিরাপত্তায় নূর হোসেনকে যশোরের বেনাপোলে নিয়ে যান।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) খন্দকার মহিদ উদ্দিন গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে বলেন, নূর হোসেনের বিরুদ্ধে আদালতের জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে পুলিশের একটি দল যশোরের বেনাপোলে গেছে। এসপি বলেন, নূর হোসেনের বিরুদ্ধে সাত খুনসহ ১৩টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। এর মধ্যে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে এক বছরের কারাদণ্ডও হয়েছে তাঁর।
গত বছরের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে দুটি গাড়িতে থাকা সাতজনকে অপহরণ করা হয়। এর মধ্যে একটি গাড়িতে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম এবং তাঁর সহযোগীরা। অন্য একটি গাড়িতে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়িচালক। তিন দিন পরে অপহৃত ব্যক্তিদের লাশ ভেসে ওঠে নারায়ণগঞ্জের উপকণ্ঠে শীতলক্ষ্যা নদীতে। এ ঘটনা সারা দেশে হইচই ফেলে দেয়।
অপহরণের পরদিন অপহৃত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ফতুল্লা থানায় নূর হোসেনসহ ছয়জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলার এজাহারে ‘র‍্যাবকে দিয়ে’ অপহরণের অভিযোগ করা হয়। তিন দিন পরে লাশ উদ্ধার হলে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। পরে আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে আরেকটি হত্যা মামলা করেন।
কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম প্রথমে র‍্যাবের বিরুদ্ধে ‘ছয় কোটি টাকা নিয়ে’ অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ করেন। অর্থায়নকারী হিসেবে তিনি নূর হোসেনকে অভিযুক্ত করেন। পরে তদন্তে এ ঘটনার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জে র‍্যাব-১১-এর কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা বের হয়ে আসে। র‍্যাব-১১-এর তৎকালীন অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার এম এম রানাসহ অন্য সদস্যরা মিলে ওই সাতজনকে অপহরণের পর হত্যা করে পেট চিরে লাশ নদীতে ফেলে দেন বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। প্রায় এক বছর তদন্তের পরে গত এপ্রিলে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। এতে র‍্যাবের ওই তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
নূর হোসেন হলেন অভিযোগপত্রভুক্ত ১ নম্বর আসামি। অভিযুক্ত ৩৫ জনের মধ্যে বর্তমানে র‍্যাবের তিন কর্মকর্তাসহ ২২ জন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। ২২ জনই ঘটনার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। পলাতক আসামিদের মধ্যে র‍্যাবের আট সদস্য রয়েছেন।
ট্রাকচালকের সহকারী হিসেবে জীবন শুরু করা নূর হোসেন ১৯৯২ সালে বিএনপির সাবেক সাংসদ গিয়াসউদ্দিনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে যোগ দেন বিএনপিতে। সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি শামীম ওসমানের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। বাংলাদেশ ট্রাকচালক শ্রমিক ইউনিয়ন কাঁচপুর শাখার সভাপতি হন। তাঁর বিরুদ্ধে দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৩টি মামলা হয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁকে ধরিয়ে দিতে ইন্টারপোলে রেড নোটিশও পাঠানো হয়। ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের পর তিনি এলাকায় ফেরেন। পরে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে তিনি ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। কাঁচপুরে শীতলক্ষ্যা নদী দখল করে বালু-পাথরের ব্যবসা, উচ্ছেদে বাধা, পরিবহনে চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে বারবার আলোচনায় আসেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লা থানায় ছয়টি হত্যা মামলাসহ ২২টি মামলা রয়েছে।
নূর হোসেনকে দেশে ফেরত আনায় নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম সন্তোষ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি গতকাল রাতে বলেন, নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। এই হত্যাকাণ্ডে তাঁর সঙ্গে আর কারা জড়িত, পরিকল্পনাকারী কারা তা বের করা হোক। তিনি বলেন, তাঁর স্বামীর সঙ্গে র‍্যাবের কোনো বিরোধ ছিল না। তাই নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী কারা, তা বের করা হোক। কারণ, মামলার অভিযোগপত্রে পরিকল্পনাকারী কে, তা আসেনি।
সেলিনা ইসলামের মতো একই দাবি করেছেন নিহত মনিরুজ্জামানের ভাই মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, নূর হোসেনের সঙ্গে র‍্যাবের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সম্পর্ক এক দিনে গড়ে ওঠেনি। তাই নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেই হত্যার পরিকল্পনাকারী ও খুনিরা শনাক্ত হবে।