খোলা বাজার২৪ ॥ শনিবার, ১৪ নভেম্বর ২০১৫: শোরে তৈরি শৌখিন পাখির বাসা ইউ পের ছয় দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এতে বছরে কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে দেশে। এর মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছে এ অঞ্চলের হাজারো নিম্ন আয়ের মানুষ।
ইউরোপের জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, স্পেন ও পর্তুগালের বিভিন্ন শহরে শৌখিন পাখি উৎপাদনের খামারে যাচ্ছে ৪০ ধরনের পাখির বাসা। তবে পুঁজির সংকটের কারণে এ পণ্যের রপ্তানি বাণিজ্যে যতটা প্রসার ঘটার কথা ছিল, ততটা ঘটেনি বলে দাবি উদ্যোক্তাদের।
এ পণ্য রপ্তানির অন্যতম উদ্যোক্তা ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকার বাসিন্দা খায়রুল আলম। তিনি যশোরের কয়েকটি গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষের মাধ্যমে পাখির বাসা তৈরি করান। পরে এগুলো রপ্তানি উপযোগী করে নৌপথে বিদেশে পাঠান।
জানতে চাইলে খায়রুল আলম বলেন, ‘যশোর সদর উপজেলার আবাদ কচুয়া, সীতারামপুর ও বাহাদুরপুর গ্রামে তৈরি শৌখিন পাখির বাসার ইউরোপের বাজারে ব্যাপক চাহিদা। অন্তত ৪০ ধরনের পাখির বাসা ছয়টি দেশে এখন রপ্তানি করা হচ্ছে। বর্তমানে বছরে প্রায় ১ কোটি টাকা মূল্যের পাখির বাসা রপ্তানি হচ্ছে।’
সম্প্রতি আবাদ কচুয়া ও সীতারামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, ঘরে ঘরে পাখির বাসা তৈরির কাজ চলছে। ঘরের বারান্দা ও আঙিনায় বসে নারী-পুরুষ মিলে পাখির বাসা বুননের কাজ করছেন। পুরুষেরা বাঁশের চাটাই দিয়ে বুননের মূল উপকরণ তৈরি করছেন। নারীরা বাসা তৈরির জো (কাজের শুরু) তুলছেন। আরেকজন বাসা তৈরির কাজ শেষ করছেন।
আবাদ কচুয়া গ্রামের দাসপাড়ার কিনারাম দাসের বাড়ির উঠানে গিয়ে দেখা গেল, তিনি তলতা বাঁশের চাটাই চিরে দা দিয়ে সুচারু করছেন। পাশে বসে তাঁর স্ত্রী কাঞ্চন দাস ও মা রঞ্জিতা দাস বাসা বুননের জো তুলে দিচ্ছেন।
কাজের ফাঁকে কিনারাম দাস বলেন, ‘৩০ বছর ধরে পাখির বাসা তৈরির কাজ করছি। ৪০ ধরনের বাসা বানাতে পারি। বাঁশ, পাট, কাতা (নারকেলের ছোবড়া), খড়, বিচালি, বাঁশের পাতা, কাঠ—এ-জাতীয় নানা উপাদান দিয়ে এ বাসা তৈরি করা হয়। যখন যে ধরনের অর্ডার থাকে, তখন সেই ধরনের বাসা তৈরি করা হয়।’
কিনারাম বলেন, ‘বড় ধরনের বাসার জন্য ৭ টাকা, মাঝারি ৫ ও ছোট বাসার ক্ষেত্রে ৩ টাকা করে মজুরি দেওয়া হয়। তিনজন মিলে কাজ করে মাসে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ বড় বাসা তৈরি করা যায়। মজুরি কম হলেও কাজটি বাড়িতে বসেই করা যায়। নারীরাও তা করতে পারে। তবে বাঁশের দাম এখন বেড়েছে। আমরা মজুরি বাড়ানোর জন্য দাবি তুলেছি।’
এ কাজ করে কিনারাম সংসার চালিয়েও পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। আগে তাঁরা ছাপরাঘরে থাকতেন। এখন পাকা বাড়িতে থাকেন, এটাই তাঁদের আনন্দ। এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রায় সবাই টিনের ছাউনির পাকা বাড়ি করেছেন। পার্শ্ববর্তী সীতারামপুর গ্রামের ঋষিপাড়ার চণ্ডীদাস ৩০ বছর আগে প্রথম পাখির বাসা তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন।
সীতারামপুর গ্রামে চণ্ডীদাসের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, চণ্ডীদাস ও তাঁর মেয়ের জামাই আরনল্ড বিশ্বাস নারকেল ও পাট দিয়ে বাবুই পাখির বাসার মতো বাসা তৈরি করছেন। আরনল্ড পুঁজির সংকটের কারণে এ পণ্যের রপ্তানি বাণিজ্যে যতটা প্রসার ঘটার কথা ছিল, ততটা ঘটেনি বলে দাবি উদ্যোক্তাদেরবিশ্বাস বলেন, ‘উচ্চমাধ্যমিক পাস করে অন্য চাকরিতে যাইনি। ছোটবেলা থেকে পাখির বাসা তৈরির কাজ শিখেছি। এখন এ কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করি।’
চণ্ডীদাস বলেন, শুরুর দিকে ঢাকার সেলিম সাহেব একটি নমুনা বাসা এনে বলেন, এ ধরনের পাখির বাসা তৈরি করতে পারো কি না দেখো। সঙ্গে সঙ্গে আমরা কয়েকজন ওই রকম বাসা তৈরি করে দিলাম। সেই থেকে সেলিম সাহেব আমাদের পাখির বাসা তৈরির কাজ দেন। প্রথমে আমরা ৩০ জনকে বাসা তৈরির প্রশিক্ষণ দিই। সেই থেকে কাজ করে যাচ্ছি।’
সুখলাল বলেন, গ্রাম থেকে পাখির বাসা সংগ্রহ করে এ কেন্দ্রে এনে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে প্রতিটি বাসার গায়ে লেবেল দিয়ে ১২টা করে প্যাকেট করা হয়। পরে কার্টনে করে ট্রাকের মাধ্যমে ঢাকার অফিসে পাঠানো হয়। সেখান থেকে বিদেশে যায়।
এ শিল্পের মূল উদ্যোক্তা খায়রুল আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরির চেষ্টা করেননি। উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নে তিনি পাখির বাসাসহ পোষ্য প্রাণীর নানা উপকরণ বিদেশে রপ্তানি করেন।
খায়রুল আলম বলেন, ‘৩০ বছর আগে যশোরের বেসরকারি সংস্থা ‘বাঁচতে শেখা’র নির্বাহী পরিচালক আঞ্জেলা গোমেজের মাধ্যমে যশোরে গিয়ে পাখির বাসা তৈরি শুরু করেছিলাম। এখনো সে কাজ চলছে।’ তিনি বলেন, ‘বিদেশ ব্রিডিং বার্ড বা পোষা পাখির চাষ হয়। আমাদের দেশের তৈরি পাখির বাসায় ওই পাখি ডিম পাড়ে, বাচ্চা ফুটায়। যে কারণে বিদেশে এ বাসার অনেক চাহিদা। আগে চীনের দখলে ছিল ইউরোপের পাখির বাসার বাজার। সেখানে শ্রমের দাম বৃদ্ধি ও বাসা তৈরির উপকরণের সহজলভ্যতা না থাকায় বাজারটি আমরা পেয়েছি। পুঁজির অভাবে আমরা ঠিকমতো প্রসার ঘটাতে পারছি না। সরকার এ খাতে সহজ শর্তে ঋণ দিলে ইউরোপ-আমেরিকার পোষ্য পাখির উপকরণ রপ্তানির বাজার আমাদের দখলে আসবে।