খোলা বাজার২৪ ॥ সোমবার, ১৬ নভেম্বর ২০১৫ : মেয়র ও চেয়ারম্যান দলীয় আর কাউন্সিলর বা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্দলীয়—এমন ব্যবস্থাকে ‘জগাখিচুড়ি’ বলে মত দিয়েছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এর ফলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে না এবং পরিষদের সামগ্রিক ক্ষমতা কমে যাবে। আর রাজনৈতিক দলের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করেই যে এ রকম সিদ্ধান্ত, সে কথার স্বীকৃতি মিলছে আওয়ামী লীগ নেতাদের কথায়।
আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা বলেছেন, বিপুলসংখ্যক প্রার্থী বাছাইয়ের মতো সাংগঠনিক প্রস্তুতি কোনো দলেরই নেই। নির্বাচন কমিশনের জন্যও এর কার্যকর ব্যবস্থাপনা দুরূহ হবে। আওয়ামী লীগও তৃণমূল পর্যায়ে মনোনয়নকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত এড়াতে এ পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেছে।
অন্যদিকে তিন জন পৌর মেয়র বলেছেন, সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা বা সংলাপ না করে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। এতে মেয়র ও চেয়ারম্যানের সঙ্গে কাউন্সিলর ও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের দূরত্ব বাড়বে। এমনকি রাজনৈতিক পরিচয়ে নির্বাচিত মেয়র বা চেয়ারম্যানের অবর্তমানে প্যানেল মেয়র বা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে হবে অরাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত কাউন্সিলর বা ইউপি সদস্যকে।
সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ গতকাল রোববার বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে জগাখিচুড়ি মার্কা স্থানীয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। দলীয়ভাবে নির্বাচিত মেয়র কোনো কারণে সাময়িক বহিষ্কার হলে একজন কাউন্সিলর ওই দায়িত্ব পাবেন। অথচ কাউন্সিলরকে জনগণ মেয়র হিসেবে ভোট দেয়নি, দলও তাঁকে মনোনয়ন দেয়নি। তিনি মনে করেন, পরিষদ থাকলেও কাউন্সিলর বা সদস্যদের ক্ষমতা সীমিত। তার ওপর মেয়র ও চেয়ারম্যান দলীয় প্রতীকে হলে পরিষদের ক্ষমতা আরও কমে যাবে।
তবে আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাউন্সিলর ও সদস্য পদে দলীয়ভাবে প্রার্থী বাছাই করার মতো সক্ষমতা বা প্রস্তুতি ছিল না দলটির। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে অনেক শক্তির কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় একজনকে প্রার্থী করতে গিয়ে অন্যদের খেপিয়ে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সংঘাত সৃষ্টি করার ঝুঁকি নেওয়া হয়নি।
১৯৯৩ সাল থেকে মেহেরপুর পৌরসভায় স্বতন্ত্র নির্বাচন করে বারবার মেয়র হয়েছেন মুতাসিম বিল্লাহ। তিনি বলেন, কোনো দলের গঠনতন্ত্রেই স্থানীয় সরকারের প্রার্থী দলীয়ভাবে মনোনয়নের বিষয়টি নেই। এ অবস্থায় দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ওপর কেউ মামলা করতে পারেন। তাঁর মতে, মেয়র দলীয় আর কাউন্সিলর নির্দলীয় হলে মেয়রের সঙ্গে কাউন্সিলরদের দূরত্ব বাড়বে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা সাড়ে চার হাজারের বেশি। ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান, সদস্য ও নারী সদস্য মিলে ১৩টি পদ আছে। এ ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে ইউনিয়ন পরিষদেই প্রায় ৫৮ হাজার প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হতো। এক পদে একাধিক প্রার্থী থাকলে কয়েক লাখ প্রার্থীর মধ্য থেকেই বাছাই করার দরকার হতো। একইভাবে সারা দেশে পৌরসভা আছে ৩২৩টি।
২ নভেম্বর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দলটির সংসদীয় বোর্ডের সভায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সারা দেশে এত প্রার্থী বাছাই করা কঠিন এবং এতে তৃণমূল পর্যায়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বেড়ে যাবে বলে মত দেন অধিকাংশ সদস্য। এ ছাড়া দলীয় সিদ্ধান্ত না মানলে বহিষ্কারের প্রসঙ্গ আসবে। এসব আলোচনার সূত্র ধরে প্রধানমন্ত্রী কেবল মেয়র ও চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার পরামর্শ দেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, একসঙ্গে কাউন্সিলর ও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের দলীয় মনোনয়ন দিতে গেলে প্রার্থী কমে যেতে পারে—এমন আলোচনা ছিল। আর এত প্রার্থী বাছাই করাও কঠিন। এ জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন। সেই বিবেচনা থেকেই এ উদ্যোগ।
তবে দলের একাধিক সূত্র জানায়, সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল তৃণমূলে নিজের অবস্থান সংহত করা। মেয়র ও চেয়ারম্যান দলীয় হলেই সেই উদ্দেশ্য সফল হয়। এ জন্যই সব পর্যায়ে দলীয় মনোনয়ন থেকে সরে আসে সরকার।
মিউনিসিপ্যাল অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ম্যাব) সভাপতি ও পাবনার বেড়া পৌরসভার মেয়র আবদুল বাতেন বলেন, কাউন্সিলর বা ইউপি সদস্য পদে দলীয় মনোনয়ন হলে প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা কমে যেত।
অবশ্য ম্যাবের মহাসচিব ও নাটোরের সিংড়া পৌরসভার মেয়র শামিম আল রাজির মতে, সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্তটা স্ববিরোধী। কেউ দলীয়, কেউ আবার নির্দলীয়—এটা হয় না। তাঁর মতে, আসলে তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েই ঝামেলা তৈরি করা হয়েছে। সরকারের উচিত ছিল সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা।
এদিকে পৌরসভা আইন সংশোধনের জন্য স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) বিল, ২০১৫ গতকাল সংসদে উত্থাপিত হয়। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বিলটি উত্থাপন করেন। উত্থাপনের পর বিলটি তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। বিলটি পাস হলে ২ নভেম্বর পৌর আইন সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির জারি করা অধ্যাদেশ বাতিল হয়ে যাবে। ওই আইনে বলা হয়েছিল, পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলর পদে দলীয় পরিচয় ও প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তবে গতকাল উত্থাপিত প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, শুধু মেয়র পদে রাজনৈতিক দলের পরিচয় ও প্রতীকে নির্বাচন হবে।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, বিলটি দ্রুত পাস করার জন্য আজ বেলা তিনটায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে এবং আজই বিলটি চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। ১৮ নভেম্বর বিলটি পাসের জন্য উত্থাপন করা হতে পারে।