খোলা বাজার২৪ ॥ সোমবার, ১৬ নভেম্বর ২০১৫ : মুসলমানদের অনুভূতিতে চরমভাবে আঘাত হানে ইতালির কট্টর ডানপন্থী ‘ডেইলি লিবেরো’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার এমন শিরোনামে খবর ছাপা হয়েছে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সুন্নিপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নৃশংসতম হামলার পর দিনই পত্রিকাটির ওই শিরোনাম ছিল রীতিমতো উসকানিমূলক।
ঘটনার পর দুটি বিপরীত অনুভূতি ফ্রান্সকে গ্রাস করেছে; প্রথমত শোক আর পরেরটি সন্দেহ, অবিশ্বাস ও ক্ষোভ। ঘটনার পর দেশটিতে বসবাসকারী মুসলমানরা প্রায় গুটিয়ে এলেও তাদের নিয়ে এই সন্দেহ ফ্রান্সের সীমান্ত ছাড়িয়ে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপ একই ভাষায় ভাবছে- বিষয়টি এমন না হলেও বেশির ভাগ মানুষই এখন সব মুসলমানকে আইএসের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করছে। আর এই বিবেচনা প্রকাশে এখন আর কোনো রাখঢাক নেই। আড়ালে নেই মুসলমানদের মধ্যে থাকা আতঙ্ক আর ভীতিও। একই সঙ্গে শরণার্থীদের প্রবেশ নিয়ে কড়াকড়ি আরোপের বিষয়টিও প্রবলভাবে সামনে এসেছে।
প্যারিসের এক রেস্তোরাঁয় কাজ করেন বাংলাদেশি যুবক রাশেদুজ্জামান তালুকদার (২৯)। শুক্রবারের হামলায় তাঁর দুই সহকর্মী নিহত হন। রাশেদ যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন এর মালিকের স্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে তাঁরা প্যারিসের লা কারিয়োঁ রেস্তোরাঁয় যান। পার্টি শুরু হওয়ার পরপরই এক বন্দুকধারী গুলি ছুড়তে শুরু করে। জন্মদিনের উৎসবেই নিহত হন মালিকের স্ত্রী। মারা যান রাশেদের দুই সহকর্মী। ওই পার্টিতে তাঁরও যাওয়ার কথা ছিল। যাওয়া না হওয়ায় বেঁচে যান তিনি। বলছিলেন, ‘সার্বিকভাবে প্যারিস স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। তবে চাপা অস্বস্তি, উৎকণ্ঠা পিছু ছাড়ছে না।’ রাশেদকে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার মুখে পড়তে হয়নি। ঘটনার পরদিন কাজে গিয়েছিলেন তিনি। রোজ ১০ ঘণ্টা কাজ করলেও গত শনিবার চার ঘণ্টা করেই বাড়িতে ফিরেছেন। কালের কণ্ঠকে তিনি জানান, পুরো পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর মধ্যে আতঙ্ক আছে।
প্যারিসের একটি দোকানে কাজ করেন জাহিদুল ইসলাম। ঘটনার পর তাঁরা দোকান খুলেছিলেন। তবে ক্রেতা প্রায় ছিল না বললেই চলে। রাস্তায় বের হওয়া ফরাসির সংখ্যাও খুব কম। তিনি বললেন ‘ক্ষোভ বা বিদ্বেষ নয়, সন্দেহ কাজ করছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এখানে বিদেশিদের, বিশেষ করে যারা শ্বেতাঙ্গ নয় তাদের খুবই সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে।’ প্যারিসের মুসলিমপ্রধান এলাকা হিসেবে পরিচিত বেনলি। সেখানকার মানুষের ভীতি অবশ্য রাশেদ বা জাহিদের চেয়েও অনেক বেশি। ২৪ বছর বয়সী আমিনা কাইমা বলেন, ‘আমি পর্দা করি না। তবে আমার মা আর বোন করেন। ওরা বাড়ি থেকে বের হলেই লোকে বুঝে ফেলে যে ওরা মুসলিম। বিষয়টি ভয়ংকর হয়ে উঠছে আমাদের জন্য।’ তিনি আরো বলেন, এই ঘটনা ফ্রান্সকে দুই টুকরো করে ফেলেছে। এক দল এর জন্য মুসলিমদের দোষ দিচ্ছে। আরেক দল দিচ্ছে না।
আমিনা বলেন, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম। আমরা আশা করব, মানুষ ইসলামের সঙ্গে ইসলামিক স্টেটকে মিলিয়ে ফেলবে না। আমাদের বুদ্ধি খাটিয়ে সহিংসতা মোকাবিলা করতে হবে। ফ্রান্সকে বিভক্ত নয়, ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ সংকটের মোকাবিলা করতে হবে।’ তবে আমিনা যতটা সাহস দেখিয়ে নিজের নাম প্রকাশ করেছেন ততটা সাহসী নন অনেকেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একই এলাকার আরেক ব্যক্তি বললেন, তাঁর বাসা থেকে ফ্রান্সের জাতীয় স্টেডিয়াম স্তাদে দ্য ফ্রঁস খুব একটা দূরে নয়। জানালা দিয়ে বিস্ফোরণের দৃশ্য দেখেছেন তিনি। বলছিলেন, ‘সব জায়গায় পুলিশ। আমি খুবই ভয় পেয়েছি। দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে বসেছিলাম। এখনো বাসা থেকে বের হইনি।’
তাঁর মতো লোকের সংখ্যা কম নয়। কাজকর্মে যাওয়া ছেড়ে বাড়িতেই বন্দি হয়ে আছেন। মুসলমানদের মধ্যে এই ভীতি অমূলক নয়। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ইতালির ‘ডেইলি লিবেরো’র ভয়ংকর শিরোনামে খবর ছাপা। ফ্রান্সের রাজনীতিকদের মধ্যেও এই বিদ্বেষ বা কাঠিন্য কম নেই। ডানপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা মারিন ল পঁ সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাত থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি তুলেছেন। এক টেলিভিশনে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, ফ্রান্সকে অবশ্যই ইসলামী সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি মসজিদগুলো বন্ধ করা এবং বাইরে থেকে ইসলামী ধর্মীয় নেতাদের আসাও নিষিদ্ধ করতে হবে। তাঁর ভাষায়, এরাই ঘৃণা ছড়ায়। অবৈধ অভিবাসীদের প্রবেশে কড়াকড়ি এবং দ্বৈত নাগরিকত্বধারী ফরাসি মুসলিম নাগরিকদের পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে হবে।
পুরো ইউরোপের পরিস্থিতিও এর চেয়ে খুব ভিন্ন কিছু নয়। নেদারল্যান্ডসের বিরোধী নেতা গির্ট উইলডার্স বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট আমি আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি, সীমান্ত বন্ধ করে দিন। এই মুহূর্তেই। ডাচদের বাঁচতে দিন। আপনারা সন্ত্রাসী আর অভিবাসীর মধ্যে পার্থক্য করতে পারছেন না।’ ইতিমধ্যেই সীমান্তে কড়াকড়ির নির্দেশ দিয়েছেন ডাচ প্রধানমন্ত্রী। তবে একই সঙ্গে তিনি এও বলেন, ‘আমরা কোনো দেশ বা বিশ্বাস বা ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামিনি।’ কিন্তু ডাচ সরকারের এই উদারতার আশপাশ ঘেঁষেনি পোল্যান্ড। তারা ইতিমধ্যেই প্যারিসে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে অভিবাসীদের জন্য সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত কয়েক মাসে সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশ থেকে ইউরোপমুখী যে শরণার্থী স্রোত শুরু হয় তারই পরিপ্রেক্ষিতে ইইউ সংগঠনভুক্ত সব দেশের জন্য শরণার্থী প্রবেশের সুযোগ দিয়ে একটি কোটা বেঁধে দেয়। সেই কোটা ব্যবস্থা এখন হুমকির মুখে পড়েছে।
স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিসো বলেন, ‘এই কোটা ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে ইউরোপে জঙ্গিরা ঢুকে পড়ছে। ফলে নিরাপত্তায় ঝুঁকি রয়েছে। আমি এই ব্যবস্থার বিরোধিতা করছি।’ হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর আরবান জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘তিনি ভুল করেছেন। হামলার ঘটনা মার্কেলের শরণার্থী নীতিকে চাপের মধ্যে ফেলবে। আমরা কোটার এই ব্যবস্থা মেনে নিতে চাই না।’ এ ক্ষেত্রে ইতালির জাতীয়তাবাদী পার্টি নর্দান লীগ নেতা মতিওঁ সালভেনি সবচেয়ে আগ্রাসী। তিনি বলেন, ‘অভিবাসীরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এরা নিরাপত্তায় কোনো সাহায্য করে না। তবে সন্ত্রাসী যদি অভিবাসীদের দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্মের হয় তাহলে বিষয়টি দাঁড়াবে এমন যে আমাদের সমাজ ও গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামের সামঞ্জস্য নেই। দুটিতে খাপ খাচ্ছে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘ইতালিতে বসবাসকারী সব মুসলমানকেই নজরদারির আওতায় আনতে হবে। গলাকাটা ইসলামী সন্ত্রাসীদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে।’
এদিকে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান জানায়, ইউরোপের প্রায় ১৫ হাজার লোকের সই করা এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইউরোপে কোনো মুসলমানকেই রাখা হবে না। এই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কোনো দেশে যখন মুসলিমরা যায় তাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। এ সময় তারা সংগঠিত হয়ে ওই দেশের রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করে; যা ইসলাম এবং ওই দেশের স্বাধীনতা বা সাম্যের জন্য কোনো ইতিবাচক বিষয় নয়। আর যখন তারা রাজনৈতিকভাবে বেশ ক্ষমতা পেয়ে যায় তখন ওই দেশ থেকে স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার অদৃশ্য হতে থাকে।’ তবে শুধু ইউরোপই নয়, আঁচ লেগেছে যুক্তরাষ্ট্রেও। বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার কারণেই এ ধরনের ঘটনা এত সহজে ঘটে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক মাস পরই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
প্যারিস হামলার পরের দিন শনিবার সিবিএস টেলিভিশন আয়োজিত বিতর্কে অংশ নেন ডেমোক্র্যাট দলের তিন মনোনয়ন প্রত্যাশী। তাঁদের অন্যতম সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ওই বিতর্কে বলেন, ‘চরমপন্থী জিহাদি মতবাদ, যা আইএসের মতো সংগঠন গড়তে উদ্বুদ্ধ করে তা অবশ্যই আমাদের সমূলে উৎপাটন করতে হবে। এ জন্য বিশ্বকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’ হিলারি বলেন, ‘আমরা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি না। আমরা যুদ্ধ করছি সহিংস চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে।’ অন্যদিকে ওবামা প্রশাসনের আন্তর্জাতিক নীতির সমালোচনায় মুখর হয়েছেন বিরোধী রিপাবলিকান শিবির। কয়েক দিন আগে ওবামা আগামী বছরে ১০ হাজার শরণার্থীকে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে মার্কিন কংগ্রেসের প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ মন্তব্য করেন, প্রেসিডেন্ট ওবামা ও প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারির শরণার্থী গ্রহণের চিন্তা নিছক কাল্পনিক। আর যদি শরণার্থীদের আশ্রয় দিতেই হয়, তবে কেবল খ্রিস্টান শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া যেতে পারে। বিশ্বে মুসলমানের সংখ্যা ১৬০ কোটি। আইএসকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং ধনী সন্ত্রাসী সংগঠন। এর সদস্য সংখ্যা মাত্র ১৫ হাজার।