খোলা বাজার২৪ ॥কাহিনীগুলো বেশ পুরনো। কিন্তু কেন জানি মানুষ তা আজও শুনতে চায়। শুনতে চায় তার প্রেম-প্রণয়-নিষ্ঠুরতা এবং অধঃপতনের দম বন্ধ করা নানা মুখরোচক কাহিনী। প্রেমের জন্য তিনি দেবালয় পুড়িয়েছেন। একের পর এক রাজ্য দখল করে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছেন- তবুও প্রেমিকাকে পাননি। তার প্রেমিকা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। হিন্দি কবি মানিক মোহাম্মদ জায়েসী সেই কাহিনী নিয়ে রচনা করেছেন বিরাট এক মহাকাব্য। নাম-পদুমাবৎ। প্রাচীন যুগের বাংলা কবি আলাউল আবার সেই মহাকাব্য অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন, সাহিত্যের ছাত্রমাত্রই পদ্মাবতী নামের সেই অপরূপ রাজকন্যার সঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে হারিয়ে যান ইতিহাসের সুদীর্ঘ এক পথপরিক্রমায়।
আমি যে শাহেন শাহের কথা বলছি তার নাম সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী। তার মতো সফল, সাহসী, অত্যাচারী এবং খ্যাপাটে সম্রাট ভারতবর্ষে তো নয়ই, তাবৎ দুনিয়ায় দ্বিতীয়জন খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ! আপন চাচা সুলতান জালাল উদ্দিন খিলজীকে হত্যা করে তিনি দিলি্লর সিংহাসনে বসেন ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে। মারা যান ১৩১৬ খ্রিস্টাব্দে। কাগজে-কলমে তিনি কুড়ি বছর রাজত্ব করেন। এর মধ্যে ১৮ বছর শাসন করেন সিংহ বিক্রমে এবং বাকি দুই বছর কার্যত গৃহবন্দী হিসেবে সেনাপতি মালিক কাফুরের অধীন থেকে অমানুষের মতো নিকৃষ্ট কষ্টভোগ করে মৃত্যুবরণ করেন। আজ আমি বলব তার সিংহ বিক্রমের কিছু কাহিনী এবং সবশেষে বলব নির্মম পরিণতির কিছু উপাখ্যান।
আলাউদ্দিন খিলজী লেখাপড়া জানতেন না। কিন্তু নিয়তির পরম সৌভাগ্যসমূহ তার পায়ের কাছে আছড়ে পড়েছিল বারবার। তিনি যা চাইতেন তাই হয়ে যেত। তামাম হিন্দুস্তান ছিল তার পদানত। এমনকি বিশ্বে ত্রাস সৃষ্টিকারী মোঙ্গলরাও তাকে সমীহ করে চলত। তার সেনাবাহিনী, উজির-নাজির, পাত্রমিত্র, কাজী সবাই ছিল একান্ত আজ্ঞাবহ। সবাই তাকে ভয় করত যমের মতো। সুলতানের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে পেশাব করে রাজদরবার নোংরা করার মতো অনেক ঘটনা ঘটিয়েছেন বড় বড় মন্ত্রী-আমলা কিংবা সেনাপতি। তার ইচ্ছাই ছিল সব আইনের ভিত্তি। অন্যদিকে তার অনিচ্ছাকেই প্রজারা কিয়ামতের মতো ভয় এবং সমীহ করে চলত। তার অনেক ভালো ভালো কর্ম ছিল। এগুলোর মধ্যে রাজ্যময় মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি আজও বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
সুলতান মনে করতেন, তিনি যা চাইবেন তাই হবে। নামকাওয়াস্তে ধর্ম-কর্ম পালন করতেন বটে কিন্তু নিজেকে ভাগ্যবিধাতা মনে করে আল্লাহর সঙ্গে শিরক করতেন অহরহ। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং লোভের কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। তিনি সেসব দৃশ্য দেখতেন ও উল্লসিত হতেন এবং এ কাজ করতে করতে তিনি এক সময় মানসিক বিকারগ্রস্তে পরিণত হলেন। তার আশপাশের লোকজন যখন বুঝতে পারল যে সুলতান মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন তখন তারা তাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে নিয়ে গেল। তার বিশ্বস্ত সেনাপতি মালিক কাফুর সুলতানকে আপন হেফাজতে নিয়ে ইচ্ছেমতো যাচ্ছেতাই করতে আরম্ভ করলেন। সে এক লম্বা কাহিনী, সব বলা না গেলেও কিছু চৌম্বক অংশ তো বলবই। কিন্তু তার আগে বলে নিই চিতোরের মহারানী পদ্মিনীর কাহিনী বাংলায় আমরা যাকে পদ্মাবতী বলে চিনি।
রানী পদ্মাবতীর স্বামী ছিলেন চিতোরের মহারাজা রাওয়াল রতন সিং। সমসাময়িক দুনিয়ায় পদ্মাবতীর মতো অমন রূপসী আর দ্বিতীয়জন ছিলেন না। রতন সিং স্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য চিতোরে নির্মাণ করেছিলেন সুরক্ষিত দুর্ভেদ্য দুর্গ। তারপরও পদ্মাবতীর রূপের কাহিনী চলে যায় সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর কানে। সময়টা ছিল ১৩০৩ সালের। রতন সিংয়ের দুশমন রাঘব চেতন দিলি্লতে এসে সুলতানের কাছে পদ্মাবতীর অপরূপ রূপের কাহিনী বর্ণনা করলেন। সুলতান প্রেমের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলেন। তিনি তার সেনাবাহিনীর চৌকস দলকে চিতোর বিজয়ের জন্য পাঠালেন। উদ্দেশ্য যে কোনো মূল্যে পদ্মাবতীকে দিলি্লর হারেমে নিয়ে আসা। সুলতানের বাহিনী চিতোর দুর্গের পাদদেশে গিয়ে বুঝল এই দুর্গ বিজয় অসম্ভব। তারা সুলতানকে চিঠি লিখে সব কিছু জানাল। সুলতান স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন।
সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী তার অনন্য সাধারণ সামরিক প্রতিভা দ্বারা বুঝলেন, চিতোর দুর্গ জয় করা অসম্ভব। তিনি কৌশলের আশ্রয় নিলেন। পদ্মাবতীর স্বামী রতন সিংকে খবর পাঠালেন যে তিনি পদ্মাবতীকে ধর্মের বোন বানাতে চান। তাকে শুধু দূর থেকে একনজর দেখতে চান। তারপর তিনি অবরোধ উঠিয়ে ফিরে যাবেন দিলি্লতে। বিনিময়ে রতন সিংয়ের রাজ্য জীবনে কোনো দিন আক্রমণ করবেন না। রাজপুতরা সবাই সুলতানের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় বসল, কোনো রাজপুত রমণীকে পরপুরুষের সামনে প্রদর্শন রীতিমতো অবমাননাকর। শান্তির স্বার্থে নেতারা অনেক ভেবেচিন্তে বিকল্প এক উপায় বের করলেন। সিদ্ধান্ত হলো সুলতানকে চিতোর দুর্গে আমন্ত্রণ জানানো হবে। একটি কামরার মধ্যে স্থাপন করা হবে বৃহদাকার আয়না। পদ্মাবতী পাশের কামরাতে বসবেন এবং সুলতান অন্য কামরায় স্থাপিত আয়নায় পদ্মাবতীর ছবি দেখবেন।
নির্ধারিত দিনে বিশ্বস্ত কয়েকজন দেহরক্ষী নিয়ে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী চিতোর দুর্গে প্রবেশ করলেন। রানী পদ্মাবতীর প্রতিবিম্ব আয়নায় দেখার পর তিনি আরও অস্থিরতা অনুভব করলেন। যে কোনো মূল্যে পদ্মাবতীকে পাওয়ার জন্য তিনি প্রায় উন্মাদ হতে বসলেন। কিন্তু আপন প্রতিভা দ্বারা তিনি মনের বিষ গোপন রাখলেন। প্রাসাদ থেকে বের হওয়ার আগে তিনি রাজা রতন সিংয়ের সঙ্গে কোলাকুলি করলেন এবং ধর্ম ভগ্নিপতি হিসেবে তাকে মহামূল্যবান উপহার সামগ্রী হস্তান্তর করলেন। রাজা সরল বিশ্বাসে সুলতানকে প্রাসাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ঘুরে দেখালেন। আর এই সুযোগে সুলতানের সফরসঙ্গী সামরিক গোয়েন্দারা চিতোর দুর্গের কৌশলগত দুর্বল জায়গাগুলো নির্ধারণ করে ফেলল। আবেগে আতিশয্য রতন সিং তার দুর্গের বাইরে এসে কিছুটা পথ সুলতানকে এগিয়ে দিলেন। আর সেই সুযোগে সুলতান তাকে খুন করে বসল এবং সদলবলে চিতোর দুর্গ আক্রমণ করল।
সুলতানের চৌকস বাহিনী দ্বারা চিতোর দুর্গ বিজিত হলো বটে কিন্তু পদ্মাবতীকে জয় করা সম্ভব হলো না। তিনি প্রাসাদের সব রাজপুত মহিলাকে নিয়ে বিষপানে আত্দহত্যা করলেন। ১৫৪০ সালে মালিক মোহাম্মদ জায়েসী পদুমাবৎ কাব্য রচনা করে ১৩০৩ সালের চিতোর দুর্গের কাহিনীকে ইতিহাসে অমরত্ব দান করেন। পদ্মাবতীর আত্দহনন সুলতানের মনে গভীর রেখাপাত করতে আরম্ভ করে। তিনি আস্তে আস্তে মানসিক বৈকল্যের দিকে এগুতে থাকেন। তার নিত্যকার আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে আমির ওমরাহ প্রজারা সব অস্থির হয়ে পড়ে। কিন্তু ক্ষমতার দাপটে তিনি ছিলেন এতটাই ক্ষমতাধর যে, তার যে কোনো অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দ তো দূরের কথা- মুখ কালো করার উপায় ছিল না।
সুলতান যখন যা ইচ্ছে তাই করতেন। অকারণে হাসতেন, আবার অকারণে কাঁদতেন। যাকে ইচ্ছে শাস্তি দিতেন বিনাকারণে। যাকে ইচ্ছে তাকে পুরস্কৃত করতেন। নিম্নস্তরের চাকর-বাকরকে মন্ত্রী-ফন্ত্রী বানিয়ে দিতেন। আবার গোস্বা হলে বড় বড় মন্ত্রীকে মেথর বা আস্তাবলের ঘোড়ার রক্ষক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করতেন। শেষ বয়সে কেন জানি তার বানরপ্রীতি বেড়ে গেল। বানরের লাফালাফি, ভেংচি কাটা এবং কিচিরমিচির ডাক তার খুবই ভালো লাগত। দিলি্লর কাছাকাছি তার জন্য সংরক্ষিত বনাঞ্চল যেখানে তিনি প্রায়ই মৃগয়াতে যেতেন সেখানে তিনি বানরদের জন্য একটি অভয়ারণ্য গড়ে তোলেন। তিনি প্রায়ই তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বানরের মতো ভেংচি কাটতে, লাফ দিতে কিংবা কিচিরমিচির শব্দ করতে নির্দেশ দিতেন। যে কর্মকর্তা বানর হওয়ার প্রতিযোগিতায় যত বেশি দক্ষতা দেখাতে পারত তার পদোন্নতি এবং প্রভাব তত বেশি বৃদ্ধি পেত।
দিলি্লতে যখন এসব ঘটছিল তখন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানি জীবিত ছিলেন। তার লিখিত ফতওয়া ই জাহানদারী কিংবা তারিখ ই ফিরোজশাহী পড়লে আজও অবাক না হয়ে পারা যায় না। জিয়াউদ্দিন বারানি বলেন, সুলতান তার জীবনের শেষ পাঁচটি বছর পুরোপুরি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। সারা জীবনের অন্যায়-অবিচার এবং নিষ্ঠুরতার কারণে তিনি শেষ বয়সে এসে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তার হাতে নিহত লক্ষ মানুষের আত্মা নাকি সুলতানকে ভীষণ জ্বালাতন করত। সারা দিন তিনি বানর নিয়ে খেলতেন এবং রাত হলে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়তেন। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই তিনি তার প্রাসাদ হাজার হাজার মোমের আলোতে প্রজ্বলিত করতেন এবং একান্ত আপনজনদের তার সঙ্গে সারা রাত জেগে থাকতে বাধ্য করতেন।
মালিক কাফুর ছিলেন তার প্রধান সেনাপতি এবং হাজার দিনার দিয়ে কেনা দাস। কাফুরের মাধ্যমেই তার জীবনের বড় বড় সব বিজয় অর্জিত হয়। সুলতান তাকে প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবাসতেন। অন্যদিকে কাফুরও সুলতানকে ভালোবাসতেন অত্যধিক। কিন্তু শেষ বয়সে সুলতানের পাগলামিতে তিনিও ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। সুলতান একদিন তাকে নির্দেশ করেন বানর হওয়ার জন্য। প্রকাশ্য রাজদরবারে প্রধান সেনাপতিকে বানরের মতো লম্ফঝম্ফ করতে হয়- ভেংচি কেটে সুলতানকে আনন্দ দিতে হয় এবং কিচিরমিচির শব্দ করে উত্তম বানর হওয়ার জন্য অন্যান্য মনুষ্যরূপী বানরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। ঘটনার রাতে মালিক কাফুর একটুও ঘুমালেন না। লজ্জা-অপমান এবং ঘৃণায় তার সারা শরীর রিরি করতে লাগল। এ অবস্থায় তিনি সুলতানের পোষা বানরটির কাছে গেলেন। বানরের গলায় বাঁধা স্বর্ণের শিকলটি হাতে তুলে নিলেন। তারপর মুক্ত করে দিলেন ওটিকে।
এবার অস্ত্রধারী দেহরক্ষীদের নিয়ে ঢুকে গেলেন সুলতানের প্রাসাদে। তাকে নজরবন্দি করলেন এবং তার গলায় পরিয়ে দিলেন বানরের স্বর্ণ শিকল। এরপরের ঘটনা আরও করুণ এবং বর্ণনার অযোগ্য। অত্যাচারী এবং জালেম শাসককে পরবর্তী দুটি বছর বানর হিসেবে জীবিত থাকতে হয়েছিল এবং বানরের মতো উঁচু স্থান থেকে লাফ দিতে গিয়ে মরতে হয়েছিল।
শুধু কি আলাউদ্দিন খিলজী? না- আরও আছে, ইতিহাসের শত সহস্র জালেম শাসকের করুণ পরিণতির হাজারো মহাকাব্য বিশ্বসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে কিন্তু সমৃদ্ধ করেনি আমাদের মন ও মানসিকতাকে। মজলুম অবস্থায় আমরা মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখি কিন্তু মসনদ আমাদের জাহেলিয়াতের সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে যায়। আমাদের জুলুম দেখে আজাবের ফেরেশতারা অবাক হয়ে ভাবে- ওরা ওসব শিখল কী করে? আমাদের কুবুদ্ধি দেখে শয়তানরা সব একত্রে গলা মিলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে- এখন আমাদের কী হবে? ওদের কারণে তো কিয়ামত তাড়াতাড়ি চলে আসবে- আর কিয়ামত এলে তো আমরা আর বাঁচতে পারব না- আমাদেরও মরতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট।