খোলা বাজার২৪ ॥ বুধবার, ১৮ নভেম্বর ২০১৫: দিনাজপুরে দুর্বৃত্তের গুলিতে আহত ইতালীয় নাগরিক, ধর্মযাজক ও চিকিৎসক পিয়েরো পিচমকে আজ বুধবার সন্ধ্যায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর শারীরিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল আছে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
পিয়েরো পিচম দিনাজপুর শহরের নাভারা ক্যাথলিক মিশনে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
পুলিশ বলছে, ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক ও রংপুরে জাপানি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দিনাজপুরে ইতালীয় নাগরিকের ওপর হামলা একই সূত্রে গাঁথা।
আজ বুধবার সকাল সোয়া আটটার দিকে দিনাজপুর শহরের মির্জাপুর এলাকায় বি আরটিসি বাস ডিপোর কাছে পিয়েরো পিচমকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় লোকজন তাঁকে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। চিকিৎসকের বলেন, দুর্বৃত্তের গুলি তাঁর মাথায় না লেগে মাথার ঠিক নিচ দিয়ে কাঁধ বরাবর ডান দিক দিয়ে ঢুকে বাম দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে বলে প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন তিনি। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিকেল পৌনে চারটার দিকে বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে পিয়েরো পিচমকে ঢাকার সিএমএইচে পাঠানো হয়। সন্ধ্যা ছয়টার পরে তাঁকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়।
বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হচ্ছে পিয়েরো পিচমকে। সিএমএইচের চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক আবদুল মজিদ ভূঁইয়া বলেন, ‘পিয়েরো পিচমকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর জ্ঞান আছে। তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল।’
নাভারা ক্যাথলিক মিশনের ইনচার্জ ফাদার জন বাপ্তিস্তা জাংকী বলেন, পিয়েরো পিচম (৫২) পেশায় চিকিৎসক। ৩০ বছর ধরে তিনি রাজশাহী-দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মিশনারিজের অধীন চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত। ২০০৭ সালে তিনি দিনাজপুর শহরে নাভারা মিশনে যোগ দেন। আজ সকাল আটটার দিকে নাশতা খাওয়ার পর প্রতিদিনের মতো সাইকেল নিয়ে মিশন থেকে বেরিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর তিনি গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর আসে।
পিচমের চশমা, মাস্ক ও দুর্বৃত্তের ছোড়া গুলির খোসা
ঘটনার পর সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, দিনাজপুর সরকারি কলেজ মোড় থেকে শহর বাইপাস সড়ক দিয়ে বাস টার্মিনালে পৌঁছানোর আগে বি আরটিসি বাস ডিপোর মাত্র ৩০ গজ উত্তরের ঘটনাস্থলটি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। ঘিরে রাখা স্থানে গুলিবিদ্ধ পিয়েরো পিচমের ব্যবহৃত চশমা, মাস্ক এবং দুর্বৃত্তের ছোড়া গুলির খোসা পড়ে থাকতে দেখা যায়। সড়কের বেশ কিছু অংশ রক্তে ভেজা। ওই স্থানে আশপাশের বাড়িগুলোর বেশির ভাগই ছাত্রাবাস। দিনাজপুর সরকারি কলেজ, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এসব ছাত্রাবাসে থাকেন বলে এলাকাবাসী জানান।
গুলির শব্দের পরই তিন যুবক মোটরসাইকেলে চলে যান
ঘটনাস্থলের ৫০ গজ সামনে বি আরটিসি বাস ডিপো-সংলগ্ন পান দোকানদার মো. নূরুল মিয়া বলেন, সকাল আটটা ১০ মিনিটে হঠাৎ গুলির শব্দ শোনা যায়। ওই সময় একটি মোটরসাইকেলে তিন যুবককে ঘটনাস্থলের পশ্চিম দিকের সড়ক দিয়ে দ্রুত চলে যেতে দেখা যায়। মোটরসাইকেলের চালক হেলমেট পরা এবং পেছনের ব্যক্তির শরীরে চাদর মোড়ানো ছিল। এরপর সেখান থেকে লোকজন চিৎকার করেন, ‘ধর ধর, লোকটাকে গুলি করে মেরে ফেলল! চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন বেরিয়ে আসে।’
ঘটনাস্থলের পাশেই বন্ধন ছাত্রাবাস। ওই ছাত্রাবাসের মালিক মো. খতিব উদ্দিন জানান, হঠাৎ পটকা ফাটানোর মতো শব্দ শুনে বাসা থেকে বেরিয়ে তিনি দেখেন, একজন বিদেশি নাগরিক রাস্তায় পড়ে আছেন। সাইকেলটি তাঁর পাশে। কেউ তাঁকে তুলতে যাচ্ছে না। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এরপর তিনি দিনাজপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. বাবুল হোসেনের সহায়তায় তাঁকে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে তুলে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন।
হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক চিকিৎসক এ টি এম জিল্লুর রহমান বলেন, সকাল পৌনে নয়টার দিকে পিয়েরো পিচমকে হাসপাতালে ভর্তির পরই অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। তিনি ছাড়া সার্জারি বিভাগের প্রধান পার্থ সারথি রায়, চক্ষু বিভাগের প্রধান হারিসুর রহমান, নাক কান গলা বিভাগের প্রধান বুলন্দ আখতার, কার্ডিওলজি বিভাগের কনসালট্যান্ট ইফতেখার হাসান মোল্লা, নিউরোলজি বিভাগের প্রধান বদরুল হাসান সমন্বয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল পিচমের অস্ত্রোপচার করেন। অস্ত্রোপচারের পর তাঁকে সার্জারি বিভাগের ৩১৮ নম্বর কেবিনে রাখা হয়।
পিচমের ডান দিকে ঢুকে বা দিক দিয়ে গুলি বেরিয়ে গেছে
জিল্লুর রহমান বলেন, গুলি পিয়েরোর কাঁধের ঠিক ওপরে চামড়ার ভেতরের ডান দিক দিয়ে ঢুকে বা দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এতে গভীর কোন ক্ষত সৃষ্টি করেনি। সাইকেল থেকে পড়ে যাওয়ায় কপালে আঘাত পেয়েছেন। সামান্য অংশ কেটেও গেছে। তবে তাঁর জ্ঞান ছিল। তিনি কথা বলছেন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কামুক্ত। যদিও মাথায় আঘাত পাওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে ৪৮ ঘণ্টা পার না হওয়া পর্যন্ত তিনি পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত বলা ঠিক হবে না।
বেলা ১১টার দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পিয়েরোর কেবিনে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। দুই চোখ ফোলা। শরীরে স্যালাইন চলছে। চিকিৎসকেরা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে দিচ্ছেন না। চিকিৎসকেরা উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকায় নেওয়ার কথা জানালে তিনি বলেন, ‘আমার কিছু হয়নি। এখানেই ভালো আছি। ঢাকায় যেতে হবে না। এই হাসপাতালেই ভালো হয়ে যাব।’
হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের প্রধান হারিসুর রহমান জানান, পিয়েরোর চোখের চারদিকে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। এ কারণে চোখ ফুলে গেছে। তবে তাঁর দৃষ্টি শক্তির কোনো ক্ষতি হয়নি।
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক তরুণ কান্ত হালদার বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য পিয়েরোকে বিকেল পৌনে চার টার দিকে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় পাঠানো হয়।
কুনিও-সিজারের ওপর হামলা একই সূত্রে গাঁথা
পুলিশ সুপার মো. রুহুল আমিন বলেন, জেলায় বিদেশি নাগরিকদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা বিধানের অংশ হিসেবে সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হামলার শিকার ধর্মযাজক তা মানতেন না। ঘটনার পর পুলিশ র্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে আলামত সংগ্রহ করেছেন। ঘটনার মোটিভ পর্যবেক্ষণ করছেন। পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ঘটনা তদন্ত করছে বলে তিনি জানান।
পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি মো. হুমায়ুন কবির পিয়েরো পিচমকে দেখতে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন। এ সময় তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক এবং রংপুরে জাপানি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দিনাজপুরে ইতালীয় নাগরিকের ওপর হামলা একই সূত্রে গাঁথা। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের কথা বলা ঠিক না। তবে ঘটনার মোটিভ দেখে একই উদ্দেশ্য বলে মনে হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে বলে তিনি জানান।