খোলা বাজার২৪॥ শনিবার, ২৮ নভেম্বর ২০১৫: ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীর সঙ্গে এক তরুণের বিয়ের আয়োজন চলছে। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান তিনি। বর ও কনেপক্ষের কাছে বাল্যবিবাহের কুফল তুলে ধরেন। বিয়ে বন্ধের আহ্বান জানান। কিন্তু কোনো পক্ষই তাঁর কথা আমলে নেয় না। উল্টো তাঁকে অকথা-কুকথা শুনিয়ে দেয়। তবে তিনিও দমার পাত্রী নন। মুঠোফোনে সহযোগিতা চাইলেন প্রশাসনের। সেই রাতে অকালে বধূ হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায় ছাত্রীটি। আর বর বেশে আসা সেই তরুণ ও তাঁর বড় ভাইকে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার একটি গ্রামে ২০১৩ সালের ১৩ জুন রাতে ঘটে এ ঘটনা। এরপর থেকে তিনি একে একে প্রতিরোধ করেন আরও ৬০টি বাল্যবিবাহ। তিনি হাতীবান্ধা উপজেলার গেন্দুকুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। নাম ফরিদা ইয়াসমিন।
গতকাল শুক্রবার জেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানে লালমনিরহাটকে বাল্যবিবাহমুক্ত জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অনুষ্ঠানে ফরিদা ইয়াসমিনও অতিথি ছিলেন। জেলাটিকে বাল্যবিবাহমুক্ত করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখায় তাঁর প্রশংসা করে প্রশাসন। শুধু জেলা প্রশাসনই নয়, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে তাঁর অবদানের জন্য ফরিদা বেসরকারি সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল চ্যাপ্টারের স্বেচ্ছাসেবক ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশে একক এবং এশিয়ায় যৌথভাবে চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ডের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন।
এ বিষয়ে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের লালমনিরহাট প্রোগ্রাম ইউনিটের (হাতীবান্ধা) ব্যবস্থাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘৮ নভেম্বর এক চিঠিতে আমাদের ঢাকা কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, বাল্যবিবাহ নিরোধে অসামান্য অবদান রাখায় ফরিদা ইয়াসমিন সংস্থার বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে এককভাবে ও এশীয় চ্যাপ্টারের যৌথভাবে ভলান্টিয়ার অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হয়েছেন। এশিয়া মহাদেশে তিনি ছাড়াও ইন্দোনেশীয় এক নাগরিক রয়েছেন। একই সঙ্গে গ্লোবাল অ্যাওয়ার্ডের জন্য সাতজনের চূড়ান্ত তালিকায় আছে ফরিদা ইয়াসমিনের নাম। আনুষ্ঠানিকভাবে ফরিদার হাতে পদক তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’
ফরিদা ইয়াসমিনের বাড়ি হাতীবান্ধা শহরের মাস্টারপাড়ায়। তিনি নিজেই বাল্যবিবাহের শিকার। ১৯৮১ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর স্বামীর নাম রফিকুল ইসলাম। তাঁদের তিন ছেলে। বড় ছেলে আবু সায়িদ মো. ফরিদুল ইসলাম মার্কেটিংয়ে স্নাতক (সম্মান) পাস করেছেন। অন্য দুই ছেলের একজন ইতিহাসে স্নাতক (সম্মান) পাস করেছেন। আরেকজন মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করছেন।
হাতীবান্ধার শিঙ্গীমারী ইউপি মিলনায়তনে বাল্যবিবাহ, যৌতুক ও নারী নির্যাতন বিষয়ক মতবিনিময় সভায় যুব নারী ফোরামের সদস্যদের সঙ্গে ফরিদা ইয়াসমিন। ছবিটি সম্প্রতি তোলা ষ প্রথম আলোফরিদা শ্বশুরবাড়ির কাজকর্ম করতে ও সবার সঙ্গে মানিয়ে চলতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পান বাল্যবিবাহের কুফল। তখন থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা করেন। মনে মনে সংকল্প করেন বাল্যবিবাহের কারণে কোনো মেয়েশিশু যাতে তার শৈশব ও স্বপ্ন হারিয়ে না ফেলে, এ জন্য কাজ করবেন। ঘরকন্নার পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যান স্বামীর উৎসাহে। লালমনিরহাট সরকারি কলেজ থেকে ১৯৯৯ সালে বিএসএস (প্রাইভেট) পাস করেন। এ ছাড়া তিনি এলএলবি প্রথম ভাগ সম্পন্ন করেন। হাতীবান্ধা উপজেলার গেন্দুকুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৮৫ সালে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন। ২০০৬ সালে প্রধান শিক্ষক হন। ২০১২ সালে একই উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৫ জন নারী শিক্ষকের অরাজনৈতিক ও অলাভজনক সংগঠন আঁচল নারী কল্যাণ সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক হন। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ওই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি রূপান্তর-প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের হাতীবান্ধা ইউনিটের সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (সিএসও) নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হন। বর্তমানে তিনি এই নেটওয়ার্কের উপজেলা সহসভানেত্রী। তিনি শিশু সুরক্ষা, জেন্ডার, অ্যাডভোকেসিসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর থেকে তিনি যেখানেই বাল্যবিবাহের খবর পান, সেখানেই হাজির হন। অন্যদেরও এ কাজে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেন। প্রথমে চেষ্টা করেন অভিভাবকদের বোঝাতে, এতে ব্যর্থ হলে মুঠোফোন কিংবা লোক পাঠিয়ে পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চান।
ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমিও পেশায় একজন শিক্ষক। এ ছাড়া আমি একজন স্কাউট ও নারী সংগঠক হিসেবে শিক্ষকতা শেষে দিনের বাকি সময় বাল্যবিবাহ বন্ধ করাসহ নারী-শিশু নির্যাতন বন্ধের জন্য বিনিয়োগ করেছি। আমার স্বামী রফিকুল ইসলাম ও মা মাহফুজা বেগম এসব কাজে আমাকে উৎসাহ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। আমার তিন ছেলে, সহকর্মী, এলাকাবাসী ও অন্যরা নানাভাবে আমাকে সহযোগিতা দিচ্ছে।’
ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘সর্বশেষ গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে একই উপজেলার একটি গ্রামের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। এ নিয়ে মোট ৬১টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছি। বাল্যবিবাহ বন্ধের কাজ করতে গিয়ে শুরুর দিকে অনেক গালমন্দ শুনেছি। হুমকি-ধমকি পেয়েছি। এই তো গত বছরের মে মাসে একটি বাড়িতে আমার মুঠোফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, যাতে আমি পুলিশ বা প্রশাসনে খবর না দিতে পারি। তবু পিছপা হইনি। আমি সংকল্পে অটল। বাল্যবিবাহ বন্ধের চেষ্টা চালিয়ে যাব।’
হাতীবান্ধা মহিলা ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির (মানবিক) এক ছাত্রী বলেন, এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর গত বছরের ১৪ মার্চ রাতে পরিবারের সদস্যরা তাঁর বিয়ের আয়োজন করেন। তিনি প্রথমে রাজি না থাকলেও পরে পারিবারিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন। তবে তাঁর এক বান্ধবীর মাধ্যমে খবর পেয়ে যান ফরিদা ইয়াসমিন। তিনি ঘটনাস্থলে এসে হাজির হন। দুই পক্ষকে বাল্যবিবাহের নানা নেতিবাচক দিক সম্পর্কে বোঝান ফরিদা ইয়াসমিন। না, এতেও কাজ হয় না। কোনো পক্ষই তাঁর কথা কানে তোলে না। তিনি উপজেলা প্রশাসনকে খবর দেন। পরে বিয়ের আসর ভেঙে দেওয়া হয়।
এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করা ওই ছাত্রী আরও বলেন, ‘ফরিদা আপা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। এ জন্য আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। এখন স্বপ্ন দেখি, একদিন ব্যারিস্টার হব। নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধসহ মানবাধিকার রক্ষায় আগ্রহীদের আইনি সহায়তা দেব।’
হাতীবান্ধার টংভাঙ্গা গ্রামের এক রাজমিস্ত্রি বলেন, ‘সংসারের অভাব-অনটনের কারণে এবং কিছু মানুষের চাপে আমার সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলাম। খবর পেয়ে ফরিদা আপা এসে আমাকে মানা করেন। এ ধরনের বিয়ের ক্ষতির দিক বুঝিয়ে বলেন। এরপরও আমি মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইলে তিনি পুলিশ ডাকি আনলেন, বিয়াটা বন্ধ হয়। মেয়ে আমার এখন ক্লাস নাইনে পড়ছে। ১৮ বছরের আগে তার বিয়া দিব না।’
হাতীবান্ধার একটি উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির (বিজ্ঞান) আরেক ছাত্রী বলে, ‘২০১৩ সালের ১৪ জুলাই রাতে আমার বিয়ের আয়োজন করা হয়। তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়তাম। সেদিন ফরিদা আপা আমাকে বাল্যবিবাহের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। ফরিদা আপা আমার জীবনে আলোকবর্তিকা হয়ে এসেছেন। আমি তাঁর অনুপ্রেরণায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। বিশেষ করে নারীদের সেবা দিতে আমি চিকিৎসক হতে চাই।’
হাতীবান্ধা উপজেলায় বাল্যবিবাহ বন্ধে অবদান রাখায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তর থেকে উপজেলা পর্যায়ে ২০১৩ সালে জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ পুরস্কার পান ফরিদা ইয়াসমিন। ২০১৪ সালে উপজেলা শিশু ফোরাম তাঁকে সম্মাননা দেয়।
হাতীবান্ধা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মতিন প্রধান বলেন, ‘কোথাও বাল্যবিবাহের আয়োজন হতে পারে বা হয়েছে, এমন সংবাদ পেলে ফরিদা ইয়াসমিন আমাদের জানান। শুধু তাই নয়, সন্ধ্যা বা রাত এমনকি গভীর রাত হলেও কাউকে না কাউকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঘটনাস্থলে হাজির হন। সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন না। এমনও হয়েছে রাতে তিনি পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে নিজ বাড়ি ফিরেছেন।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহাবুবার রহমান বলেন, ‘অনেক বাধাবিপত্তি ও প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন ফরিদা ইয়াসমিন। তাঁর এই প্রচেষ্টা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে আগ্রহীদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর পুরস্কার লাভ আমাদের সবার জন্য গর্বের বিষয়।’
লালমনিরহাট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) নবেজ উদ্দিন সরকার বলেন, ফরিদা ইয়াসমিন তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সুপরিচালনার পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে যে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছেন, তা শিক্ষক সমাজের জন্য অনুকরণীয়। তিনি বলেন, একজন ভালো মা, একজন ভালো শিক্ষক, একজন ভালো স্কাউটস ও একজন ভালো নারী সংগঠক হিসেবে তিনি অনন্য।
জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান ও পুলিশ সুপার টি এম মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, ফরিদা ইয়াসমিন জেলার একমাত্র শিক্ষক, যিনি প্রায়ই বাল্যবিবাহ বন্ধে মুঠোফোনে তথ্য আদান-প্রদান করেন, পরামর্শ, সহযোগিতা নেন ও কাজ করেন।