Sat. May 3rd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

4খোলা বাজার২৪॥ মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর ২০১৫: শেষমেশ আওয়ামী লীগের অধিকাংশ তৃণমূল কমিটি পৌরসভার মেয়র পদে প্রার্থী মনোনীত করার দায় কেন্দ্রের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। দলের ভেতরে কোন্দল এবং মন্ত্রী-সাংসদদের পছন্দের প্রার্থী দেওয়ার চাপ এর উল্লেখযোগ্য কারণ বলে জানা গেছে। যেসব স্থান থেকে একক প্রার্থীর নাম কেন্দ্রে এসেছে, সেখানে স্থানীয় সাংসদেরা অনেকটা জোর করেই তা চাপিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের নিজেদের আত্মীয়-ঘনিষ্ঠজনেরাই প্রাধান্য পেয়েছেন।
আওয়ামী লীগের দপ্তর সূত্র জানায়, গতকাল সোমবার পৌরসভার মেয়র পদে দলীয় প্রার্থীর তালিকা ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে এসে পৌঁছায়। বেশির ভাগ পৌরসভাতেই একাধিক প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। কোনো কোনো জায়গা থেকে সর্বোচ্চ ১০ জনের নামও এসেছে বলে সূত্র জানায়।
গতকাল সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রার্থী মনোনয়নে গঠিত ১৮ সদস্যের কেন্দ্রীয় বোর্ড আলোচনায় বসে। বোর্ডের সভাপতি দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। গত রাত ১১টার দিকে বৈঠক শেষ হয়।
দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবাহান গোলাপ জানান, প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। আজ আরেকটি বৈঠকের পর প্রার্থীদের চিঠি দেওয়া হবে।
যোগাযোগ করা হলে বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা রাতের খাবারের বিরতির সময় জানান, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগের প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অনেক পৌরসভায় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার প্রার্থীর পুরো তালিকা প্রকাশ করা হতে পারে।
নির্বাচন কমিশন আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দলের সভানেত্রীর সই করে যাঁকে মনোনয়ন দেবেন, তিনিই নৌকা প্রতীক পাবেন। এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে মেয়র নির্বাচন হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাংসদদের খবরদারি ও আত্মীয়প্রীতির কারণে পৌরসভায় প্রার্থী বাছাই নিয়ে দলের তৃণমূলে কিছুটা অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। মন্ত্রী-সাংসদদের পছন্দ-অপছন্দের কারণেই প্রার্থীর তালিকা বড় হয়েছে। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় বোর্ডের একাধিক প্রভাবশালী সদস্য গণভবনের বৈঠকে সমালোচনা করেন। তালিকায় মন্ত্রী-সাংসদের আত্মীয়স্বজনদের নাম দেখে প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বভাবসুলভ রসিকতার মাধ্যমে তা সবার নজরে আনেন।
প্রার্থীদের তালিকা তৈরি নিয়ে গতকাল দিনভর আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির কার্যালয়ে সাংসদ, কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতা-কর্মীদের ভিড় দেখা গেছে। জেলা আওয়ামী লীগ থেকে জমা দেওয়া তালিকার সঙ্গে শেষ মুহূর্তে অনেক সাংসদ ও কেন্দ্রীয় নেতা নিজের পছন্দের নাম যোগ করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, যত নাম এসেছে, সবই দলীয় সভানেত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে অন্তত তিনটি জরিপ প্রতিবেদন আছে। কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থাও আলাদা প্রতিবেদন দিয়েছে। তৃণমূল কিংবা সাংসদেরা যতই নাম পাঠান, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে ওই সব প্রতিবেদন গুরুত্ব পাবে।
উত্তরবঙ্গের একটি জেলার সাধারণ সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা কোনো রিস্ক (ঝুঁকি) নিইনি। যেখানেই ন্যূনতম দ্বিমত দেখা দিয়েছে, সেখানেই একাধিক নাম কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাংসদদেরও মন রক্ষা করতে হয়েছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরাও জানেন তৃণমূলের কমিটির খুব বেশি ক্ষমতা নেই। তাই তাঁদের ক্ষোভও নেই।’
পৌরসভা নির্বাচনআওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সিদ্ধান্ত ছিল স্থানীয় সাংসদদের নিয়ে জেলা, উপজেলা ও পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকেরা পৌরসভার জন্য একক প্রার্থী মনোনয়ন করবেন। আর তা চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড। কিন্তু অনেক স্থানে মন্ত্রী-সাংসদেরা কমিটির সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক। ফলে তৃণমূলের প্রার্থী বাছাই কার্যক্রমে সাংসদেরা কর্তৃত্ব করেন।
একক প্রার্থী, সাংসদের স্বজন, অতঃপর কলহ: নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের কমিটি নেই দীর্ঘদিন। কমিটির আহ্বায়ক দল ছেড়ে মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যে যোগ দিয়েছেন। আহ্বায়ক কমিটির কয়েকজন সদস্য মারা গেছেন। এবার পৌরসভা নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সাংসদের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। সোনারগাঁ পৌরসভার বর্তমান মেয়র সাদেকুর রহমান। কিন্তু সেখানে এবার প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন আড়াইহাজারের সাংসদ নজরুল ইসলাম ওরফে বাবুর বোনজামাই ফজলে রাব্বী। উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি গাজী মজিবুর রহমানও নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা করে মাঠে নামেন। নজরুল ইসলামের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের আরেক সাংসদ শামীম ওসমানের দ্বন্দ্ব রয়েছে। উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের নেতাদের বেশির ভাগ শামীম ওসমানপন্থী। তাঁরা সাদেকুর রহমানের নাম পাঠান। কিন্তু সাংসদ নজরুল ইসলাম ধানমন্ডি কার্যালয়ে ফজলে রাব্বীর নাম নিজে জমা দেন। আর গাজী মজিবুর রহমান নিজেই নিজের নাম দিয়ে যান।
জানতে চাইলে সোনাগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, নজরুল ইসলাম অন্য আসনের সাংসদ। তিনি নিজের বোনজামাইয়ের নাম দিতে চাইলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ মানেনি। বর্তমান মেয়রের নামই তাঁরা এককভাবে পাঠিয়েছেন।
আর সাংসদ নজরুল ইসলাম বলেন, তিনজনের নাম তিনভাবে গেছে। এখন বাকিটা নেত্রীর পছন্দ। তাঁর বোনজামাইয়ের নাম সোনারগাঁয়ের সাবেক সাংসদ কায়সার হাসনাত সমর্থন করেছেন।
রূপগঞ্জের বরপা পৌরসভায় স্থানীয় সাংসদ গোলাম দস্তগীর গাজী তাঁর স্ত্রী হাসিনা গাজীর নাম এককভাবে পাঠানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু উপজেলার সাধারণ সম্পাদক এর বিরোধিতা করেন। পরে সাংসদের স্ত্রীর নাম প্রথমে রেখে বাকি তিনজনের নামও যুক্ত করে পাঠানো হয়।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, পরিবারের কয়েকজন সদস্য ছাড়া ওই এলাকায় সাংসদের জ্ঞাতিগোষ্ঠী নেই। তিনি সাংসদ ও উপজেলা সভাপতি। এখন স্ত্রীকে পৌর মেয়র করলে স্থানীয় লোকজন আর কী রাজনীতি করবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান ভূঁইয়া বলেন, সবারই রাজনীতি ও পদ পাওয়ার অধিকার আছে। তাই যাঁরা আগ্রহী ছিলেন, সবারই নাম পাঠানো হয়েছে। এখন কেন্দ্র যাঁকে যোগ্য মনে করে, তাঁকেই দেবে।
রাজশাহী জেলার ১৩টি পৌরসভার মধ্যে কাকনহাট, তাহেরপুর ও নওহাটায় একজন করে প্রার্থীর নাম পাঠানো হয়। চারঘাট উপজেলা ও পৌর কমিটি একক প্রার্থী হিসেবে পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল হকের নাম প্রস্তাব করে। কিন্তু ওই পৌরসভার বর্তমান মেয়র আওয়ামী লীগেরই নার্গিস খাতুন। তিনি এটা জানতে পেরে জেলা আওয়ামী লীগে নালিশ করেন। পরে জেলা আওয়ামী লীগ নার্গিসের নাম যুক্ত করে একটি সারসংক্ষেপ পাঠায় কেন্দ্রে।
জানতে চাইলে নার্গিস খাতুন বলেন, বর্তমান মেয়র হয়েও তৃণমূল আওয়ামী লীগ তাঁর আগ্রহের মূল্য দেয়নি। বাধ্য হয়ে তিনি জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে গেছেন।
রাজশাহীর বাকি নয় পৌরসভায় দুই থেকে আটজন করে প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করে কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে স্থানীয় সাংসদ আফজাল হোসেন উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক। পৌর নির্বাচনে তাঁর ভাই আনোয়ার হোসেন আশরাফের নাম এককভাবে পাঠানোর জন্য চেষ্টা চালান সাংসদ। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগ এতে বিভক্ত হয়ে পড়লে আগ্রহী আরও তিনজনের নাম জুড়ে দেওয়া হয়। তবে সাংসদের ভাইয়ের নাম দেওয়া হয় ১ নম্বরে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, সাংসদের ভাই সক্রিয় রাজনীতিতে নেই। তিনি মূলত ঢাকায় ব্যবসা করেন। হঠাৎ করে এসে প্রার্থী হওয়ার তোড়জোড় শুরু করায় তৃণমূলে অস্বস্তি তৈরি হয়।