খোলা বাজার২৪॥ মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর ২০১৫: প্রতি বছর ক্রিসমাসের মাস খানেক আগেই একটা ইমেইল পাই। এই দেশে অসংখ্য বুড়ো বুড়ি আছেন, যারা একা একা বাস করেন। হয়তো নিজের বাড়িতে, একান্ত অপরাগ হলে বৃদ্ধাশ্রমে। এখানে উন্নত, আধুনিক চিকিৎসা, নির্ভেজাল খাদ্য ও পরিবেশের কারণে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গিয়েছে অনেক বেশি। অত্যধিক বার্ধক্য ও দীর্ঘ আয়ু এখন অনেকটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ রকম অজস্র দীর্ঘায়ু মানুষ একা একা আত্মীয়-পরিজনহীন হয়ে উৎসব পার করেন।
ক্রিসমাস এদের সবচেয়ে বড় উৎসব। দীর্ঘ দিন ধরে চলে তার আয়োজন, আমেজ ও রেশ। পুরো দেশ যখন মাসাধিক সময় ধরে এই আনন্দ আয়োজনে ব্যস্ত, ঠিক তখনই কিছু অসহায়, নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ–বৃদ্ধা একা একা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
তবে পশ্চিমের সমাজ ব্যবস্থার সবচেয়ে সুন্দর দিক হলো, সমাজ সর্বদা সচেতন সবার জন্য। সামাজিক ভাবে বিভিন্ন ধরনের বঞ্চিত, কষ্টে পড়া মানুষদের দুর্দশা লাঘবের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এই পদক্ষেপের অংশ হিসেবে এই সব নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কথাও ভাবা হয়। আর তাই আমাদের অফিস থেকে নিমন্ত্রণ জানানো হয় এই সব মানুষদের উদ্দেশে কার্ড লেখার জন্য।
বর্তমান ইন্টারনেট ও ইমেইলের যুগে চিঠি-কার্ড এগুলো প্রায় দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে এবং এটা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। একজন নিঃসঙ্গ মানুষ যখন ক্রিসমাসের দিন বা তার আগের দিন তার পোস্টবক্সে একটা কার্ড পান—যেখানে অন্য একজন মানুষের কিছু উষ্ণ শুভেচ্ছা তার নিজ হাতে লেখা আছে, কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নেই, আছে শুধু একজন মানুষের জন্য আরেকজন মানুষের ভালোবাসা, সেই ভালোবাসা তাকে স্পর্শ করবেই। ক্ষণিকের জন্য হলেও তার মনে উৎসবের আমেজ এনে দেবে। অফিসের এই ডাকে সাড়া দিয়ে প্রতি বছরই দেখা যায় দলবেঁধে মানুষ লাঞ্চ টাইমে একসঙ্গে হয়ে রং বেরঙের কার্ড লিখছেন। সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য।
এখানে ক্রিসমাসের আয়োজন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একদিকে যেমন দোকানপাটে সাজসাজ রব পড়ে যায়, বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয় ক্রিসমাস ট্রি আর আলোকসজ্জার ঘনঘটা, ঠিক তেমনি একই সঙ্গে শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের দান বা চ্যারিটির উদ্যোগ। বঞ্চিত, দরিদ্র শিশু, নারী বা পরিবার যেন একই ভাবে উৎসব উপভোগের সুযোগ পায় এ জন্য বিভিন্ন বেসরকারি অফিস বা সংগঠন বাচ্চাদের জন্য উপহার সামগ্রী ও পোশাক সংগ্রহ করে। উল্লেখ্য, এগুলো একদম নতুন। প্যাকেট করা খেলনা, পোশাক মন থেকে দেওয়া উপহার। কারও অনাদর বা অবহেলায় ফেলে দেওয়া শত ছিন্ন জিনিস নয়। দোকানগুলো খাবার সংগ্রহ করে। এই পুরো আয়োজন হয় বেনামিতে। অর্থাৎ কে উপহার ও খাবার পাঠাচ্ছে তার নাম কোথাও থাকবে না। স্কুলগুলোতেও ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন ধরনের উপহার সংগ্রহ করতে থাকে। বাচ্চাদের মধ্যে এ নিয়ে উৎসাহ উত্তেজনার শেষ নেই। কে কত খাবার, ক্যান ফুড, খেলনা, কাপড় দিতে পারল সেই নিয়ে যেন এক প্রতিযোগিতা। ছোটবেলা থেকেই এদের ভেতরে দানের আনন্দের বীজ বপন করে দেওয়া হয়।
সমাজের একদল মানুষকে অভুক্ত রেখে, নিঃসঙ্গ রেখে, আরেক দল মানুষ উৎসব পালন করলে সেই উৎসব কখনো পরিপূর্ণ হয় না। উৎসবের আনন্দ তখনই পরিপূর্ণতা পায়, যখন সেই আনন্দ সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। একজন অভুক্ত, বঞ্চিত, নিঃসঙ্গ মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারার যে আনন্দ, সেই আনন্দ তুলনাহীন। আমাদের দেশেও ঈদের সময় জাকাত দেওয়ার যে প্রথা আছে, তার মূল ধ্যান ধারণাও কিন্তু এই একই উদ্দেশ্য থেকে এসেছে। নিজের আনন্দকে বঞ্চিতের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই আসল উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে জাকাতের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় অনেকটা লোক দেখানো, নাম কেনা বা জনপ্রিয়তা অর্জন। সেই জাকাতের শাড়ি, লুঙ্গি সংগ্রহ করতে গিয়ে কোনো কোনো সময় আবার পায়ের চাপে ধাক্কাধাক্কিতে মানুষ আহত বা নিহত হচ্ছে। এই পরিণতি ঠেকানোর জন্য যদি সত্যি সত্যি বেনামিতে জাকাত সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা থাকত, তাহলেই তার সত্যিকার সার্থকতা পাওয়া যেত। যেদিন দেশের আপামর জনসাধারণ, যাদের সামর্থ্য আছে, আর্থিক, মানসিক, বা শারীরিক তারা মন থেকে এক ধরনের তাগিদ অনুভব করবে উৎসবকে সবার উৎসবে পরিণত করার সেদিন আমরা পাব এক সত্যিকারের উৎসব, সর্বজনীন উৎসব।