খোলা বাজার২৪, সোমবার, ৭ ডিসেম্বর ২০১৫: স্বামীর মৃত্যুর পর একজন নারীকে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করতে হয়। সে সময়ে তার প্রয়োজন সবার সহযোগিতা। অথচ তখনই সমাজের নানা অসহযোগিতায় তাকে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়।
মায়ের ওপর ভীষণ রাগ তারানার। রাগে, দুঃখে, অভিমানে সে মায়ের সাথে সম্পূর্ণরূপে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। তারানা কেন এমন করছে? কারণ জানতে চাইলে ওর সোজাসাপ্টা উত্তর- বাবার মৃত্যুর পর মায়ের আবার বিয়ে।
মায়ের আবার বিয়ে সেজন্য তারানাকে তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-পড়শির কাছে হেনস্তা হতে হচ্ছে। শ্বশুরবাড়ির মানুষ আড়ালে কিংবা প্রকাশ্যে মায়ের পুরনায় বিয়ে নিয়ে কথা বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। আমার স্বামীও মাঝে মাঝেই রসিকতা করে। বলে, আমার কবরের মাটি শুকাতে না শুকাতেই তুমি আবার বিয়ে করবে। ওই মায়েরই তো মেয়ে!
শুধু তাই নয়, মায়ের সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করে। করলে তার সম্মানের হানি হবে বলেও জানায়। তারানা ক্ষোভ প্রকাশ্যে জানায়, তার শাশুড়ি মারা গেছেন মাচ পাঁচ মাস। অথচ এরই মধ্যে তার ৬৩ বছর বয়সের প্রবীণ শ্বশুর ৪০ উত্তীর্ণ এক নারীকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছেন। এ নিয়ে অবশ্য স্বামীসহ অন্যরা কোনো একটি কথাও বলেনি। পড়ীশ-আত্মীয়দের মতে, যত বয়সই হোক, পুরুষ মানুষের একা থাকা কি সম্ভব? নাকি তারা পারেন। কিন্তু আমার মায়ের প্রসঙ্গ এলে বিষয়টি পুরোপুরিই উল্টে যায়। একজন ৪৫ বছরের নারী ইচ্ছে করলেই তো একা থাকতে পারেন। এ বয়সের নারীর আবার বিয়ের কী দরকার? এটাই সবার মত। কী করবেন আমার মা? জামাইর বাড়িতে থাকবেন? সেটাও তো সমাজের চোখে মন্দই দেখায়। মেয়ের সংসার মানেই তো জামাইয়ের গলগ্রহ। যদি মেয়ে স্বাবলম্বী হয়, তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও বিধবা নিঃসঙ্গ মা সহানুভূতি পেলেও পেতে পারেন।
এ ক্ষেত্রেও অবশ্য মাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়ে। মেয়ের অফিসে থাকাকালীন তার সন্তান-সংসারে দায়িত্ব মাকে নিতে হয়। সেখানে থাকে মায়ের একান্ত চাওয়া-পাওয়াগুলোর নিত্য উপেক্ষিত। ইচ্ছে হলেই তিনি যখন তখন ঘরের বাইরে পা রাখতে পারেন না। পারেন না কাছের মানুষদের ডেকে ভালো-মন্দ খাওয়াতে। জামাই বাড়িতে মন খুলে হাসতে, কথা বলতেও মানা। এসব বিবেচনা করেই আমার অধ্যাপক ‘মা’ হয়তো বিয়ে করেছেন।
প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও পরে অবশ্য বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। তবু পারছি কই মায়ের পাশে দাঁড়াতে। বরং মাকে আরো জায়গা করে দিচ্ছি আমাকে ভুল বোঝার। এ-ও জানি, মা-মেয়ের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার নয়। এই যে পাচ্ছি সাময়িক কষ্ট! এই ছোট্ট জীবনে এ-ও বা কম কিসের! অশ্রুসজল চোখে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলছিল তারানা।
বিলকিস বানু। তিনি তারানার মায়ের মতো শিক্ষিত স্বাবলম্বী নারী নন। স্বল্পশিক্ষিত গৃহিণী। দুটি সন্তানসহ মাত্র ৩৫ বছরে বয়সে স্বামী হারান। সহায়-সম্বলহীন বিলকিস যখন কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। তখন এগিয়ে আসেনি কোনো একজন স্বজন। বাধ্য হন পুনরায় বিয়ের পিড়িতে বসতে। তবে সামাজিক সম্পর্কের মতো তার দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টি সেইভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি।
দ্বিতীয় বিয়ে কেন আত্মপ্রকাশ করতে পারেননি তা জানতে চাইলে বিলকিস বলেন, ভদ্রলোকের স্ত্রী শারীরিক অসুস্থ থাকায় তিনি বিকল্প হিসেবে আমাকে বিয়ে করেন। বিয়েতে শর্তছিল, তিনি আমার ও সন্তানদের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করবেন। কিন্তু স্বামীর পরিচয় নিয়ে কখনোই তার কর্মক্ষেত্র বা পরিবারে আমার প্রবেশাধিকার থাকবে না। দ্বিতীয় বিয়ে করছে জানলে সমাজে তাকে হেনস্তা হতে হবে। সম্মান-সুখ্যাতিতে চিড় ধরবে। সন্তানদের কথা শুনতে হবে। ইত্যাদি কারণদর্শিয়ে তিনি আমাদের সম্পর্ককে বরাবরই আড়াল করে আসছিলেন।
বিলকিস বলেন, আমাদের দাম্পত্য জীবনে কোনো সন্তানও আসতে দেননি। অবশেষে যখন আমার সন্তানেরা সমাজের উ”চস্তরে আসন করে নিলো, তখন যেন তার সুর পাল্টে যেতে লাগল। আমার সন্তানেরা তারও সন্তান হয়ে এলো সমাজ সংসারে। বুঝি বাস্তবতা অনেক কঠিন। তাই বাস্তবতাকে সব পরিস্থিতিতে মেনে চলার চেষ্টা করছি। বুঝি নিয়ে স্বামী হারানো নারীর জীবনটাই বিড়ম্বনার। সে যতই শিক্ষিত, স্বাবলম্বী কিংবা মুক্ত মনের নারী হোক না কেন? অথচ মৃত্যু তো এক অমোঘ সত্য। যেকারো জীবনেই মৃত্যু হানা দিতে পারে। মৃত্যু কেড়ে নিতে পারে যেকোনো মানুষেরই প্রিয়জনকে, জীবনসঙ্গীকে। সঙ্গী হারিয় একা হয়ে যেতে পারে যে কোন নারী কিংবা পুরুষ। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। একজনের মৃত্যু আরেকজনের জীবনকে থমকে দেয়া নিশ্চয় কিন্তু তাকেও বেঁচে থাকতে হয়। পালন করতে হয় সমাজের পরিবারের যাবতীয় দায়িত্ব। স্বামীর মৃত্যুর পর একজন নারীকে কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবেল করতে হয়। পরিবারের অর্থের জোগান যেমন ঠিক রাখতে হয়, তেমনি সন্তান ছোট থাকলে তাদের মানুষ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে প্রত্যেক নারীরই স্বাধীনতভাবে সিদ্ধান্ত করার অধিকার আছে, তার পরবর্তী জীবন কিভাবে কাটাবেন সে ব্যাপারে। কেউ যদি একাএকা বাকি জীবন কাটাতে চান, সেটা যেমন সম্মানের, তেমনি কেউ যদি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন সেটাই বা অসম্মানের হবে কেন?
মনোবিজ্ঞানী নাজমা চৌধুরী। বছর ঘুরতে চলল তার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। নিজ অভিজ্ঞতা ও বিধবা বরণকারী নারীদের কথা বিবেচনা করে নাজমা চৌধুরী বলেন, শিক্ষতি, অশিক্ষিত, পরনির্ভর বা স্বাবলম্বী নারী: সে যে অবস্থানেই থাকুক না কেন, বৈধব্য বরণ করামাত্র্ নারী কতটা অসহায় বোধ করেন, তা আমি ভুক্তভোগী বলে নয়, নারীমাত্রই বুঝতে পারেন। তবে দুঃখের বিষয় হলো, তারা যতটা বুঝতে পারেন, ঠিক ততটাই যদি সত্যিকার অর্থে সহমর্মী হতেন, তাহলে হয়তো অবস্থাটা ভিন্ন হতো। কিন্তু বাস্তবতা দেখতে পাই সম্পূর্ণই এর বিপরীত। বিধবা কোনো নারী যদি একটু সাজগোজ করেন, রঙিন কাপড় পরেন, একটু হাসি-আনন্দে জীবন সময় কাটান, যোগ্য জীবন সঙ্গী বেছে নেন-ঠিক তখন কিন্তু সহকর্মী, বন্ধু, আত্মীয় নারীরাই তার নিন্দার ব্যাপারে থাকেন এগিয়ে। দীর্ঘ দিন ধরে লালিত ধ্যান-ধারণাকে সবার সামনে উপস্থাপন করেন। তাদের ভাষায়, এমন নারীরা থাবেন ঘরের এক কোণে জড়সড় হয়ে। তার পরনে থাকবে সাদা থান। কোনো প্রুকার অলঙ্কার, সাজসজ্জা, রঙিন কাপড় তার জন্য হবে বেমানান। মলিন বেশভুষা, মলিন মুখই তার জন্য বরাদ্দ। আর তা হবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। এমনটা আমাদের ধর্মে-কর্মে কোথাও লেখা নেই। জীবনকে সৎ সুন্দর পথে পরিচালনা করাই ধর্মের এক অদ্বিতীয় লক্ষ্য। সেই লক্ষকে হেলায় উড়িয়ে দেয়া, অস্বীকার করা, সমালোচনার স্বার্থে হলেও আমাদের জন্য হবে অনুচিত।