খোলা বাজার২৪,মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৫: জ ‘অস্ট্রেলিয়ার ওই দলটা আমার পোষা কুকুর কোচিং করালেও চ্যাম্পিয়ন হতো’, জন বুকাননের কোচিং যোগ্যতাকে এর চেয়ে বেশি কিছু মনে করেন না মাইকেল ক্লার্ক। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের হালচাল দেখে মনে হচ্ছে এ দেশের ক্রিকেটেও রটনা রয়ে যাবে, ‘মাশরাফি বিন মর্তুজার মতো নেতা থাকলে জিততে আর কাউকে লাগে না!’ না, এমন হঠকারী সিদ্ধান্তে এখনো পৌঁছেনি প্রথম দল হিসেবে এবারের বিপিএল সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলা ভিক্টোরিয়ানস, পৌঁছাবেও না ভবিষ্যতে।
মাশরাফি নিজেও দলের সাফল্যে সম্মিলিত অবদানকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। তবে কাল টানা দ্বিতীয় ম্যাচে বোলিং করেননি মাশরাফি বিন মর্তুজা, ব্যাটিংয়ে নামতে হয়নি উল্টো একটা ক্যাচ ফেলেছেন। তবু তিনি ফ্র্যাঞ্চাইজির কাছে অমূল্য। গ্যালারির দর্শকদের নয়নের মণি, প্রতিটি ম্যাচের পর পুরস্কার বিতরণী মঞ্চ থেকে সংবাদ সম্মেলন কক্ষে যাওয়ার পথে তাঁকে ঘিরে সংবাদকর্মীদের ঢল। ভারতের সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলীকে ঘিরে থাকা কলকাতার সাংবাদিকদের সর্বভারতীয় মিডিয়া নাম দিয়েছিল ‘দাদা ব্রিগেড’। নিঃসন্দেহে ‘মাশরাফি ব্রিগেড’ তার চেয়ে বহরে বহুগুণ বড়। সংবাদ সম্মেলনে সাফল্যের রসায়ন বলেন মাশরাফি, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনেন সবাই। মাশরাফির চোটজর্জর দিনলিপির প্রতিটি মুহূর্তে কঁকিয়ে ওঠে সম্মেলন কক্ষ। তিনি যে কাল একটা ক্যাচ ফেলেছেন-সে প্রশ্নটি উঠলই না! সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে কুমিল্লার দল গঠনের ‘মাস্টারস্ট্রোক’ নিঃসন্দেহে মাশরাফির অন্তর্ভুক্তি। মাঠে দল জিতে চলেছে, মাঠের বাইরে মাশরাফির ব্র্যান্ডভেল্যু কুমিল্লার সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। আশা করা যায়, এত দিনে প্লেয়ার্স বাই চয়েসে মাশরাফিকে নেওয়ার বহুমুখী লাভটা বুঝতে পারছেন ভিক্টোরিয়ানসের মালিক। বোর্ডের অন্দরমহলেও একটা উপলব্ধি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
বিপিএল মাদকতা ছড়াতে গিয়ে উইকেটের ব্যাপারটা সম্ভবত ভুলেই গিয়েছিলেন আয়োজকরা। টানা খেলা হতে হতে জেরবার অবস্থা মিরপুরের উইকেটের। চট্টগ্রাম পর্বের কারণে মাঝে দিন সাতেকের বিশ্রাম মিলেছে বটে, তবে ‘প্রাণহীন’ মিরপুরের উইকেটে প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য যা মোটেও যথেষ্ট নয়। তাই টি-টোয়েন্টিতে টসের ফর্মুলা যতই প্রথমে ব্যাটিং করে রানের পাহাড় গড়ে তোলা হোন না কেন, মাশরাফি কাল নিয়েছেন ফিল্ডিং, তা বিপক্ষ দলে ক্রিস গেইল থাকা সত্ত্বেও। বুঝতে বাকি নেই, টুর্নামেন্টের বাকি ম্যাচগুলোতেও টসজয়ী অধিনায়ক কাঁটা বিছানো উইকেটে প্রতিপক্ষকে ব্যাটিংয়ে নিমন্ত্রণ জানাবেন সানন্দে। স্রেফ উইকেটের কারণে মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা টস জেতার পর মাশরাফি মেলে ধরেন তাঁর ব্ল– প্রিন্ট। সোহাগ গাজী দলে নেই তো কি, বাঁহাতি গেইলকে সামলাতে দুপ্রান্ত দিয়ে অফ স্পিনার লেলিয়ে দেন মাশরাফি। ‘গেইলফোর্স’কে থামাতে বেশি সময়ও লাগেনি। পঞ্চম ওভারেই শোয়েব মালিকের বলে এলবিডাব্লিউ হয়ে যান ক্যারিবীয় দানব। গেইলের চার-ছক্কার আশায় গ্যালারিতে ভিড় করা দর্শক সে কী খুশি-মাশরাফির দল সাফল্য পেল যে! ‘গেইলজ্বর’ সেরে যাওয়ার পর নির্ভার ভিক্টোরিয়ানস ক্রমাগতই চাপ বাড়িয়ে গেছে বরিশাল বুলসের ওপর। মিডল অর্ডারে মাহমুদ উল্লাহ ও সাব্বির রহমানের ৪৩ রানের জুটি খানিক আশা জাগিয়েছিল, বুলস অধিনায়ককে বোল্ড করে যা মুছে দেন আবু হায়দার রনি। টুর্নামেন্টে এটা বাঁহাতি পেসারের ১৪তম শিকার।
অবশ্য ৪ ওভারে ১২ রানে ২ উইকেট নিয়ে সবচেয়ে সফল বাঁহাতি স্পিনার আসার জাইদি, যে বিদেশিকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে মাশরাফি নিজেও খুব বেশি ইচ্ছুক ছিলেন না। সেটি প্রায় প্রতি ম্যাচের পর পরোক্ষে জানিয়ে দিচ্ছেন ভিক্টোরিয়ানস অধিনায়ক, ‘জাইদি সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিল না। কিন্তু ছেলেটা প্রতিটি ম্যাচেই দুর্দান্ত পারফরমেন্স করছে।’ কাল ব্যাট হাতেও ম্যাচ শেষ করে সাজঘরে ফিরেছেন আসার জাইদি। তবে অস্বস্তিকর উইকেটে ভিক্টোরিয়ানসের জয়ের কাণ্ডারি কিন্তু আরেক পাকিস্তানি আহমেদ শেহজাদ, প্রথম ম্যাচে যাঁর ধীরলয়ের ব্যাটিং দেখে বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধও হয়েছিল ভিক্টোরিয়ানসের ডাগআউট। ৪৩ বলে ফিফটির পর কিংবা ম্যাচ জিতিয়ে শেহজাদের শরীরী ভাষাতে যেন তারই প্রত্যুত্তরের ছাপ। কিন্তু তাতেও পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের ওপর সন্দেহের বাতাবরণ সরে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। এটাই যেন বিপিএলের ‘অভিশাপ’! বড় আশা নিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজিরা উড়িয়ে আনেন পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের, ওই দেশটির ক্রিকেটাররা এলে বিপিএলের ব্র্যান্ডভেল্যুও বাড়ে; কিন্তু সন্দেহের রাডার থেকে তাঁদের আর মুক্তি মেলে না! নিশ্চিতভাবেই বলে দেওয়া যায়, ভিক্টোরিয়ানসের মন পেতে আরো অনেক পরীক্ষা দিতে হবে শেহজাদকে। ভিক্টোরিয়ানসকেও যেমন ফাইনালের পথ মসৃণ করতে জিততে হবে অন্তত আরো একটি ম্যাচ। আইপিএলের মতো বিপিএলেও সেমিফাইনাল তিনটি। শীর্ষ দুটি দল ফাইনালে জায়গা পাওয়ার জন্য দুটি করে সুযোগ পাবে।
এ দুদলের মধ্যকার প্রথম সেমিফাইনালজয়ী দল সরাসরি উঠে যাবে ফাইনালে। তৃতীয় ও চতুর্থ হওয়া দল দুটির মধ্যকার বিজয়ী দলের বিপক্ষে প্লে-অফ খেলে ফাইনালে ওঠার আরেকটি সুযোগ পাবে প্রথম সেমির বিজিত দলটি। কাল হারলেও হাট করেই সেমিফাইনালের পথ খোলা আছে বুলসের সামনে। তবে মাশরাফির নতুন লক্ষ্য, ‘আরেকটি ম্যাচ জিততেই হবে।’ তার আগে বোলিং না করলেও ব্যথা ভুলে খেলে যাবেন ভিক্টোরিয়ানস অধিনায়ক। মাশরাফির উপস্থিতিতেই বেজায় খুশি তাঁর ফ্র্যাঞ্চাইজি। লো-স্কোরিং পানসে বিপিএলের আকর্ষণ ধরে রাখতেও মাশরাফির উপস্থিতি যেন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস গর্ব করতেই পারে, তবে এই মাশরাফি কিন্তু পুরো দেশের