খোলা বাজার২৪,বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলে কর্ণফুলী নদীতে থাকা পাক-বাহিনীর ১১টি নৌযান ধ্বংসের এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত ‘অপারেশন জ্যাকপট’।
১৯৭১ সালের ১৫ অগাস্ট রাতে হানাদার বাহিনীর নৌ-বহরে দুঃসাহসী সেই অভিযানের কয়েকদিন আগেই পাকিস্তানি আর্মির কাছে দুই সহযোদ্ধাসহ ‘প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিলেন’ অধিনায়ক কমডোর (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী।
সে যাত্রা সরকারি কর্মকর্তা আজিজুর রহমান ও তার স্ত্রীর ‘কৌশল’ ও বুদ্ধিতে প্রাণে বাঁচেন তারা।
সেই অসমসাহসিকতার কথা বলছিলেন ওই রাতের সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা খুরশিদ আলম ও প্রকৌশলী আজিজুর রহমান।
আজিজুর রহমান জানান, নৌ কমান্ডোরা প্রত্যেকে যার যার জায়গায় অবস্থান নিয়েছে কিনা সেটা নিশ্চিত করতে ওয়াহেদ চৌধুরী, ডা. শাহ আলম ও খুরশিদসহ তিনি গাড়ি নিয়ে বের হন।
“এসময় আমার স্ত্রী বলল- তোমরা সবাই পুরুষ মানুষ, বিপদ হতে পারে। আমিও সঙ্গে যাব।”
ফেরার পথে রাত দশটা নাগাদ আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনির মুখে পাকিস্তানি আর্মির বসানো চেকপোস্টের সামনে পড়ে যান তারা।
“আমাদের গাড়ি আটকে দুই পাশে আর্মি দাঁড়ালো। জানতে চাইল কোত্থেকে আসছি। আমার স্ত্রী উত্তর দিল- দাওয়াত ছিল। দাওয়াত খেয়ে বাসায় যাচ্ছি।”
তখন আমার পরিচয়পত্র দেখালাম। এরপর আর্মি অফিসারটি বলল, “জেনানা হ্যায় ছোড় দো।”
সেই রাতে ‘ভাগ্য অনুকূলে’ ছিল জানিয়ে আজিজুর রহমান বলেন, হয়ত আমার পরিচয়পত্র ও স্ত্রী থাকার কারণে গাড়ি খুলে তল্লাশি চালায়নি আর্মি।
খুরশিদের বাড়ি সুফিয়া মঞ্জিলেই ওইসময় ভাড়া থাকতেন আজিজুর রহমান। এ সুবাদেই নৌ-কমাণ্ডোদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল তার।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারির কর্মকর্তা হওয়ায় বন্দর চ্যানেলে থাকা পাকিস্তানি জাহাজের সংখ্যা, গতিবিধি ও অবস্থান সম্পর্কে তার দেয়া তথ্য নৌ কমান্ডোদের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে ‘কাজে এসেছিল’, গর্বের সঙ্গে বলেন আজিজুর।
“তল্লাশি চালালে নিশ্চিত ধরা পড়ে যেত সবাই। ধরা পড়লে আমরা মারা পড়তাম। অপারেশন জ্যাকপটও সংকটে পড়ে যেত।”
একই মত খুরশিদ আলমেরও।
“নগরীর আলকরণ এলাকায় তখন বাস ষ্ট্যান্ড ছিল। আলকরণ ও আশেপাশের এলাকায় অবস্থান নেয়া নৌ কমান্ডোরা সবাই যে যার জায়গায় পৌঁছেছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমরা বের হয়েছিলাম।
“তাদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে আমরা সুফিয়া মঞ্জিলে ফিরছিলাম। হঠাৎ দেখি সিজিএস কলোনির মুখেই আর্মি চেকপোস্ট। আজিজুর রহমান ও উনার স্ত্রী না থাকলে ওইদিন ভয়াবহ কিছু হয়ে যেতে পারতো।”
ওই অপারেশনের সফলতাও নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেন আজিজুর।
সেই স্মৃতি মনে করে আজিজুর রহমান বলেন, “পরদিন বন্দরের নৌ চ্যানেলে গিয়ে স্বচক্ষে নৌ কমান্ডোদের চালানো ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করি। এই সৌভাগ্য খুব কম মানুষেরই হয়েছে।”
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান নৌবাহিনীর ‘মাংরো সাবমেরিন’-এ প্রশিক্ষণরত নয়জন বাঙালি নৌ সেনা গোপনে লন্ডনের ভারতীয় দূতাবাসে আশ্রয় নেন। এরপর মাদ্রিদ, জেনেভা, রোম ও বার্সেলোনা হয়ে দিল্লি পৌঁছান তারা।
ভারতের পলাশীর ভাগীরথির তীরে তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষে ওই নয়জনসহ মোট ১৬০ জন নৌ কমান্ডো ১৯৭১ সালের ১০ অগাস্ট দেশে প্রবেশ করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী কমান্ডোরা কর্ণফুলি চ্যানেলে পাকিস্তানি জাহাজগুলোর গায়ে তিনটি করে মাইন স্থাপন করে নয়টি জাহাজ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেন। বাকি দুটি জাহাজ চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
ভারতীয় নৌ বাহিনীর এডমিরাল মীর কে রায়ের ‘ওয়ার ইন ইনডিয়ান ওসান’ বইয়ের আলাদা একটি অধ্যায়ে এ অপারেশনের বিস্তারিত আছে।
স্বাধীনতার কিছুসময় পরেই মধ্যপ্রাচ্যে চলে যান আজিজুর রহমান। সেখানে একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করছেন এখন।
চলতি মাসের ২ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের একটি হোটেলে নৌ অপারেশনের সেই অসম সাহসী সেনানীদের প্রথমবারের মতো সম্মাননা দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে অংশ নিতেই দুবাই থেকে ছুটে আসেন প্রকৌশলী আজিজুর রহমান।
দুঃসাহসী অপারেশন জ্যাকপটের অন্য কুশীলবদের সঙ্গেও সেখানেই দেখা হয় তার। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় ‘সুফিয়া মঞ্জিলকে’ও সম্মাননা নামফলক দেয়া হয় ওই অনুষ্ঠানে।