খোলা বাজার২৪, শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫: বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনশক্তি প্রেরণকারী দেশ। তবে অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়, অনিরাপদ অভিবাসন এবং সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের ধীর গতির কারণে সংকুচিত হয়ে পড়েছে দেশের শ্রমবাজার। গত দশ বছরে নতুন কোনো শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারেনি বাংলাদেশ। বরং মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অনেক সম্ভবনার চলমান শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেছে।
এমতাবস্থায় সরকার দুষছেন জনশক্তি রফতানিকারকদের আর জনশক্তি রফতানিকারকরা দুষছেন সরকারকে। অন্যদিকে অভিবাসন ব্যয় বেশি হওয়ায় শ্রমবাজারের চলমান সংকট কাটছে না বলে মনে করছেন বিষেজ্ঞরা। তবে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
শ্রমবাজারের বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বাংলাদেশ মাইগ্রেন্টস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন জয় বলেন, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৯০ লক্ষাধিক বাংলাদেশি কর্মরত রয়েছে। এদের সিংহভাগ পুরাতন ও অভিজ্ঞ হওয়ায় আয় করেন বেশি। যে কারণে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে চলতি বছর অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ১৭ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ এক হাজার সাতশদ কোটি ডলার দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ওপর ভর করেই রিজার্ভ এই উচ্চতায় পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বিশ্বে প্রবাসী-আয়ের শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন সপ্তম। প্রবাসী আয় দেশের অর্থনৈতিক ভিতকে শক্তিশালী করছে। দেশের আর্থ-সামাজিক বা সামগ্রিক উন্নয়নে এ ‘রেমিটেন্স’ বিশাল ভূমিকা রেখেছে।
জয়নাল আবেদীন জয় আরো বলেন, সরকার কোনো সফলতা দেখাতে পারছে না। শ্রমবাজারের গতি ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারের উচিৎ রফতানিকারকদের সঙ্গে আলোচনা করে অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে কর্মী পাঠানোর ব্যবস্থা করা। রেমিটেন্সে ফ্লো বেড়েছে এটি আপেক্ষিক। আগে কর্মী প্রেরণে বাধা দূর করতে হবে। ব্যয় শূন্য ও নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে হবে।
জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রাদর সভাপতি আবুল বাসার বলেন, সমস্যা কিছু রয়েছে, তবে সহসা সেগুলো কেটে যাবে। শ্রমবাজারকে উন্মুক্ত করতে বায়রা সব সময় মন্ত্রণালয়কে সহযোগীতা করতে প্রস্তুত।
বিগত ২-৩ বছরে বাংলাদেশের জনশক্তি প্রেরণে ঘাটতি বিষয়ে বাসার বলেন, বিগত দশকে কর্মী প্রেরণে গতি কমার মূলে রয়েছে অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় এবং সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের ধীর গতি। বর্তমান সরকার মালয়েশিয়ার সঙ্গে ‘জি টু জি’ প্রক্রিয়ায় কর্মী প্রেরণের জন্য ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর চুক্তিবদ্ধ হয়। যার মধ্য দিয়ে মালয়েশিয়ায় ৫ লক্ষ কর্মী প্রেরণের সম্ভাবনা সৃষ্টি ও স্বল্প ব্যয়ে কর্মী পাঠাতে শুরু করে। কিন্তু বিভিন্ন পর্যায়ে সমন্বয়হীনতা, স্বচ্ছতা ও প্রাশাসনিক জটিলতার কারণে তা ধীর গতিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, গত তিন বছরে এ প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়ায় গেছে মাত্র ১১ হাজার কর্মী। অন্যদিকে অন্যান্য শ্রমবাজার বিশেষ করে যুদ্ধপীড়িত ইরাক, লিবিয়া, মিশরসহ বিভিন্ন দেশেও কর্মীদের অভিবাসন হচ্ছে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে। কিন্তু একটি নিরাপদ ও পর্যাপ্ত বেতন-ভাতায় অভিবাসনের জন্য এখনো ব্যয় করতে হচ্ছে বিপুল অর্থ। মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো দেশে অভিবাসনের জন্য বেসরকারিভাবে প্রয়োজন হয় ৩ থেকে ৪ লক্ষ টাকা, যা সরকার নির্ধারিত অর্থের চেয়ে ৪-৫ গুন বেশি। ফলে অভিবাসনে ইচ্ছুক অনেক কর্মীদের অর্থের যোগান দিতে হয় জমি বা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে। নয়তো চড়া সুদে ঋণ করতে হচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে।
এ বিয়য়ে মালয়েশিয়া ভিত্তিক অভিবাসী সংগঠন ‘হোপ ডোর’ এর পরিচালক নাসের বিন ওয়াসিক বলেন, শ্রম অভিবাসনকে নিরাপদ ও লাভবান করতে প্রয়োজন ‘শূন্য অভিবাসন ব্যয়’। যেখানে একজন অভিবাসীকর্মীর ভিসা, মেডিকেল, প্রশিক্ষণ ও বিমান ভাড়ার অর্থ নিয়োগকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠান বহন করবে এবং তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট দেশের মন্ত্রণালয়কে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে অভিবাসীকর্মী বান্ধব সকল সংস্থাকে ‘শূন্য অভিবাসন ব্যয়’ প্রতিষ্ঠায় একযোগে কাজ করতে হবে। তাহলেই ওই দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করতে পারবে এবং প্রতিষ্ঠিত হবে অভিবাসীদের অধিকার।