খোলা বাজার২৪, শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫ : যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সেই দেশে সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য বন্ধে আইন প্রণয়নের একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার মধ্যে আইন কমিশনের এই উদ্যোগের খবর জানা গেছে।
এই বিষয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বৃহস্পতিবার বলেন, গত ১৩ ডিসেম্বর মাসিক সভায় নতুন এই আইনের খসড়া তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
“যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলবে, যারা শহীদদের বিরুদ্ধে কথা বলবে; যারা একাত্তরের অত্যাচার অবিচারকারী, খুনি, গণহত্যাকারীদের পক্ষে কথা বলবে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এই আইনটা করা হবে ইনশাল্লাহ।”
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনককে নিয়ে গত ২১ ডিসেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদার বক্তব্যের আগে লন্ডনে থেকে তার ছেলে তারেক রহমানের কাছ থেকেও বিতর্কিত বক্তব্য আসে। এরপর উচ্চ আদালত তারেকের বক্তব্য প্রচার ও প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দেয়।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের উপর পরিচালিত গণহত্যা অস্বীকৃতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান নাৎসিদের ইহুদি নিধনের ঘটনা অস্বীকারও (হলোকাস্ট ডিনায়াল ল) শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
‘হলোকাস্ট’ আইনের আলোকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবমাননার আইন করার পরিকল্পনা বলে জানান বিচারপতি খায়রুল হক।
“একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে আমরা এখনও নাম ঠিক করতে পারিনি। তবে হলোকাস্ট আইনের আলোকেই হবে।”
দলগতভাবে কেউ মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বললে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টা প্রস্তাবিত আইনের থাকবে কি না- প্রশ্ন করা হল তিনি বলেন, তারাও দায়ী হবে। তবে এখনও নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না।
“ওটা আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব। আইনটা কী হবে, সেটা আমরা দেখব। তবে এটা ঠিক, যারাই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলবে, তাদের বিরুদ্ধেই আইনটা।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা হাত দিয়েছি, কবে নাগাদ এই খসড়া হবে সেটা বলা মুশকিল। তবে আমরা রিসার্চ টিম তৈরি করেছি। গবেষণা করে কাজটা করতে অনেক সময় লাগবে।”
“আমাদের কাজ শেষ হলে আমরা এটা আইন মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠাব।”
পুরাতন আইন যুগোপযোগী করাসহ নতুন আইন প্রণয়নে কাজ করে আইন কমিশন। এক্ষেত্রে আইনের খসড়া তৈরি করে সুপারিশ আকারে আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়।
আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের একটি ড্রাফটিং বিভাগ আছে। সেই বিভাগও নতুন আইনের খসড়া তৈরির কাজ করে। সরকারের অনুমোদনের পর আইন প্রণয়ন করে সংসদ।
আইন কমিশনের অনেক সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে হারিয়ে যায়- বিষয়টি তুলে ধরা হলে বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, “এটা সরকার বলতে পারবে। এটা তো আমি বলতে পারব না।
“আমাদের কাজ আইন তৈরি করা করা। সময় সুযোগ বুঝে সব সময় আইন তৈরি করা মুশকিলও হয়ে যায়। বাকিটা হল সরকারের ব্যাপার।”
সরকারের তরফ থেকে এই ধরনের কোনো উদ্যোগ আছে কি না,- এ প্রশ্নের জবাবে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাসরিন বেগম ‘না’ সূচক উত্তর দেন।
তিনি আরও বলেন, “তবে আইন কমিশন সুপারিশ দিলে আমরা নিয়ম অনুসারে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ইহুদিদের সংখ্যা নিয়ে কোনো সন্দেহ প্রকাশও ‘হলোকাস্ট ডিনায়াল ল’তে শাস্তির আওতায় পড়ে।
এই বিষয়টি নিয়ে গত বছর প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর লেখেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নাজি বাহিনী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে গণহত্যা চালিয়েছে, তাকে অস্বীকার করার চেষ্টা, এমনকি গণহত্যার তীব্রতা লঘু করে দেখার প্রচেষ্টাও এই আইনে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।”
সাংবাদিক সাগর জানান, ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত আমেরিকান ইতিহাসবিদ অধ্যাপক বার্নার্ড লুইস একবার ফরাসি সংবাদপত্র লা মঁদে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন যে ‘আর্মেনিয়ায় যে হত্যাযজ্ঞ হয়েছে, সেটি গণহত্যার সংজ্ঞায় পড়ে না’।ওই মন্তব্যের কারণে একটি ফরাসি আদালত তাকে জরিমানা করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর গণহত্যা বিষয়ে মন্তব্য করে পশ্চিমের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ডেভিড আর্ভিংকে ১৩ মাস জেল খাটতে হয়েছিল বলে সাগরের লেখায় আসে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অধ্যাপক পিটার আর্লিন্ডারকে রুয়ান্ডার একটি আদালতের তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার কথাও লেখেন তিনি।