Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

42 সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫ : অসরৎ-ঐ-অসঁবন্ধ ও রুগ্ণ কল-কারখানাগুলোর জমি বেসরকারি খাতে বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ রেখে শিল্প নীতি চেয়েছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
রোববার ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অফ কমার্স, বাংলাদেশ (আইসিসিবি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের শিল্প নীতি’ শীর্ষক এক সংলাপে তারা এই দাবি তুলে ধরেন।
তবে অনুষ্ঠানে শিল্পোদ্যোক্তাদের হতাশ করে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, সরকারি কারখানা বিক্রি বা ইজারা দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে পিপিপি হতে পারে।
সংলাপে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ, মীর আখতার হোসেন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর নাসির হোসেন, উত্তরা গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান মতিউর রহমানসহ আরও কয়েকজন বন্ধ ও রুগণ সরকারি কারখানার জমি বরাদ্দের দাবি তোলেন।
তারা বলেন, সরকারের বন্ধ বা রুগণ শিল্প প্রতিষ্ঠানের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুণতে হচ্ছে এবং তা সরকারের রাজস্ব আয় থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা জমির অভাবে বিনিয়োগ করতে পারছে না।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির বলেন, “সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কারণে অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ বিষয়ে শিল্পনীতিতে কিছু নেই। এটা থাকা উচিত। এছাড়া শিল্পায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় সৃষ্টির উদ্যোগও থাকতে হবে।”
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ এই সংগঠনের সাবেক আরেক সভাপতি আজাদ বলেন, “সরকার বলছে কারখানা চালাবে। আমি কাউকে ছোট করার জন্য বলছি না, মূল্যায়ন করার জন্য বলছি, আজকে আমার কথাগুলো রেকর্ড করে রাখেন।
“ছয় মাস বা এক বছর পর আবার এই বিষয়ে আলোচনায় বসেন। মূল্যায়ন করেন সরকার তার কারখানায় কী করতে পেরেছে, আর বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা কী করতে পেরেছে।”
“ঈশ্বরদীতে তিন থেকে চারশ’ বিঘার জমির উপর পাকশী কাগজ কল বন্ধ পড়ে আছে। সরকার বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিচ্ছে। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ আমাদের কাছে (বেসরকারি খাতে) ছেড়ে দেন, আমরা লাভজনক করে দেব।”
নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (নোয়াব) সভাপতি মতিউর রহমান বলেন, “সরকার রাষ্ট্রমালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠান চালানোর চেষ্টা করছে। অনেক প্রতিষ্ঠান যেগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সেগুলো ফেরত নেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয়, এটা ব্যর্থ চেষ্টা।”
তাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শিল্পমন্ত্রী আমু বলেন, “সরকারি কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান বিক্রি করা বা লিজ দেওয়া বর্তমান সরকারের নীতি নেই।
“কোনো বেসরকারি উদ্যোক্তা চাইলে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) হতে পারে। বেসরকারি খাতের কেউ প্রস্তাব নিয়ে এলে আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে দেখব।”
জমি সমস্যার সমাধানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন দ্রুত করার তাগিদও দেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
আব্দুল মোনেম লিমিটেডের মাঈনুদ্দিন মোনেম বলেন, “সরকার জমির সমস্যা সমাধানের জন্য ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে চাচ্ছে। আমি বলব, ১০০ করতে হবে, ৫টি ইকোনোমিক জোন ঠিকমত করুক তাতেই হবে।”
এ কে আজাদ বলেন,“সরকার অর্থনৈতিক অঞ্চলের কথা বলছে। কিন্তু কোন জোন কবে নাগাদ শেষ হবে, তা বলছে না। এতে আমরা আশান্বিত হতে পারি না। একটা টাইম ফ্রেম থাকতে হবে।”
শিল্পের জমি দিতে গিয়ে কৃষি জমি যাতে কমে না যায়, সেদিকেও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন অনুষ্ঠানের সভাপতি আইসিসিবি সভাপতি মাহব্বুুর রহমান।
শিল্পখাতে তথ্যভাণ্ডার দাবি
শিল্প খাতের জন্য একটি আলাদা তথ্য ভাণ্ডার গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, তথ্যভাণ্ডার না থাকায় উদ্যোক্তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কোন খাতে কী পরিমাণ শিল্প কারখানা আছে, কী পরিমাণ উৎপাদন হয়, ওই পণ্যের চাহিদা কত, দক্ষ শ্রমিক আছে কি না- এসব তথ্য না থাকায় চাহিদার অতিরিক্ত বিনিয়োগের ফলে অনেক শিল্প রুগণ হয়ে পড়ছে।
মীর নাসির দক্ষ শ্রমিক ও প্রশিক্ষণের অভাবের বিষয়টি তুলে ধরে বলেন,“উদ্যোক্তাদের কাছেও দেশের শিল্প খাতের সঠিক কোনো তথ্য নেই। সবাই একদিকে ঝুঁকছে। আমরা সবাই পোলো দিয়ে মাছ ধরার মতো কাজ করছি। উদ্যোক্তাদের গাইড করার জন্য একটি তথ্য ভাণ্ডার দরকার।”
বিল্ডের সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম বলেন, “আমাদের শিল্প খাতের অনেকগুলো দুর্বলতার মধ্যে একটি তথ্যভাণ্ডার না থাকাও বড় দুর্বলতা। এজন্য অনেকে সঠিক সিদ্ধান্ত যেমন নিতে পারে না, তেমনি অনেকে ক্ষতির মুখেও পড়ে। শিল্পনীতিতে এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিত।”
বাংলাদেশের সর্বশেষ শিল্প নীতি ২০১০-১৫ চলতি বছরের জুনে মেয়াদ শেষ হয়েছে। সরকার পরবর্তী ৫ বছরের জন্য শিল্প নীতি করার উদ্যোগ নিয়েছে।
ইতোমধ্যে আগামী ৫ বছরের শিল্প নীতির খসড়া চূড়ান্ত করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। শিগগিরই তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় তোলা হবে বলে অনুষ্ঠানে জানান শিল্পসচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়াঁ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ দেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের কম সুদে ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।
“বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে ঋণ নিচ্ছে। এই ঋণের সুদবাবদ অর্থ চলে যাচ্ছে। এখন ২৭ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ আছে। এত রিজার্ভ আমাদের দরকার না। এর থেকে একটা অংশ দেশের শিল্প খাতে ঋণ দিলে আমরা যে সুদ বিদেশে দিচ্ছি, সেটা দেশে থাকে।”
আইসিসিবি সভাপতি মাহব্বুুর রহমান ব্যাংক ঋণে সুদের হার কমানোর দাবি জানান। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন দ্রুত করার উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বিনিয়োগ বাড়ানোর বাধা অপসারণে পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
গ্যাস ও বিদ্যুতের স্বল্পতা, শিল্পের উপযুক্ত জমির অভাব, অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর অভাবকে বিনিয়োগ বাড়ানোর অন্তরায় হিসেবে দেখান তিনি।
উত্তরা গ্রুপের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান শিল্প মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন,“শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক আরোপ করা হয়, এটা কোনোভাবেই ঠিক না।”
শিল্প নীতি প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, “আমাদের দেশে কোনো কিছু নীতিমালা অনুযায়ী হয়নি। যে যেভাবে পেরেছে ঘরবাড়ি, কল-কারখানা করেছে। সরকারও যতটা পেরেছে সহযোগিতা করেছে।
“এখন আমরা একটা পর্যায়ে এসেছি। এখন আমরা সবকিছু নীতির মধ্যে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করছি, ধীরে ধীরে সব নীতির মধ্যে চলে আসবে।”
আমু সংযোজন শিল্প মালিকদের দ্রুত উৎপাদনে যাওয়ার তাগিদ দেন।
রাজধানীর মতিঝিলে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এমসিসিআই) মিলনায়তনে এই সংলাপে কর্ণফুলি ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌফিক আলী, বিয়াকের সভাপতি মোহাম্মদ এ আলী, এমসিসিআই সহ-সভাপতি আখতার মতিন চৌধুরীও বক্তব্য রাখেন।
সহযোগিতা চাইলেন মতিউর
বেসরকারি বিজ্ঞাপন পেতে সরকারি পর্যায় থেকে বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করে তা কাটাতে শিল্পমন্ত্রীর সহযোগিতা চেয়েছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান।
সংবাদপত্র শিল্পের মালিকদের সংগঠন নোয়াবের সভাপতি হিসেবে আইসিসিবির সংলাপে অংশ নেন তিনি।
মতিউর রহমান সহযোগিতা চাওয়ার পর শিল্পমন্ত্রী আমুও ‘ইতিবাচক লেখনীর’ মাধ্যমে সরকারকে সহযোগিতা করতে এই সম্পাদকের প্রতি আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে বক্তব্যে শিল্পমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে মতিউর রহমান বলেন, “শিল্পে অগ্রগতির জন্য উন্মুক্ত, বাধাহীন পরিবেশ দরকার।
“আমাদের দেশে শিল্পের অবকাঠামো দুর্বলতা, বিদ্যুৎ ঘাটতি, ট্রাফিক জ্যাম এসব বাধা সবসময় আছে। আর একটি বাধা ইদানীং দেখছি, সেটি হল বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপন সংবাদপত্র, টিভি, রেডিওতে প্রদান করায় বাধা দেওয়া হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেই এসব বাধা আসছে।
“আমাদের কাছে তথ্য আছে ৩৩টি কোম্পানিকে এ ধরনের বাধা দেওয়া হচ্ছে। তার ভুক্তভোগী আমরা – প্রথম আলো, ডেইলি স্টার। অন্যান্য সংবাদপত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
“এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে আরও বিস্তারিত আলোচনা করব। আপনার মন্ত্রণালয় সংবাদপত্রকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আশা করি, আপনি এই শিল্পের পাশে থাকবেন,” মন্ত্রীর কাছে সহযোগিতা চান মতিউর।
শিল্পমন্ত্রী বলেন, “আপনাদের আমরা সাহায্য করব। আপনারও নেগেটিভ না লিখে পজিটিভ লেখনীর মাধ্যমে আমাদের সাহায্য করবেন।