Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

21খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫: ২০১৫ সাল পুরোটাই ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানিতে ভরা। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যেসব মানববসতি আছে, প্রায় প্রতিটি স্থানেই ছিল সহিংস হামলা আর সংঘর্ষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে পুরো আশির দশক পর্যন্ত যে স্নায়ুযুদ্ধ ছিল, তা যেন আবার মূর্ত হয়ে উঠেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রুশরা কোণঠাসা হওয়ার পর থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আধিপত্য বিস্তারে খোলা ময়দান পেয়ে যায়। টানা দুই যুগ ধরে সারা বিশ্বে ভীম-বেগে ছড়ি ঘুরিয়ে আসছে ওয়াশিংটন। এ বছর যেন সেই ছড়ির গতি অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে মস্কো।
সাম্প্রতিক সময়ে আরর বিশ্বে সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু তথা কৌশলগত ক্ষমতা বিস্তারের স্থান সিরিয়ায় মোটেও সুবিধা করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সব কারিকুরি ধরাশায়ী হয়েছে তেজদীপ্ত রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিচক্ষণতা ও সাহসী পদক্ষেপের কাছে। বলতে গেলে, পুতিন একাই সারা বিশ্বকে ঠেলে এক দিকে নিয়ে গেছেন। সিরিয়া ও ইরানের মতো যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের কাছে গলার কাঁটার মতো উটকো আপদ, এসব দেশের পেছনে শক্ত খুঁটি হয়ে প্রতিপক্ষকে সাঁড়াশির মতো টাইট দিয়েছেন পুতিন।
এই প্রেক্ষাপটে নতুন বছর ২০১৬ সালে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে, তা একটু পর্যালোচনা করা যাক।
বিশ্ব মোড়লের ভূমিকায় থেকে যুক্তরাষ্ট্র আর পশ্চিমা দেশগুলো চলমান সংঘাত ও সহিংসতার অবসানে যতই লাফালাফি করুক না কেন, বাস্তবে তা কোনো কাজে আসেনি। এখন সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, ২০১৬ সালটা কেমন যাবে?
আগুয়ান নতুন বছর যেভাবেই কাটুক না কেন, অস্ত্রবাজি যে কমবে না, এটা প্রায় হলফ করেই বলা যায়; বরং বোমা ও অস্ত্রের প্রাণসংহারী ভূমিকা আরও জোরালো হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে।
গত নভেম্বরে সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ১২৯ কোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তির অধীনে সৌদি আরবের অস্ত্র ভান্ডারেও বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র মজুত হবে। ইয়েমেনে যখন সৌদি আরব বিমান হামলা চালাচ্ছে, এমন সময় এই চুক্তি ভবিষ্যতে হামলার মাত্রা বাড়ার পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বরাবরই এই হামলার কঠোর সমালোচনা করে আসছে। তাদের ভাষ্য, এসব হামলায় দোষী ব্যক্তিদের চেয়ে নির্দোষ নাগরিকেরাই বেশি প্রাণ দিচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্র যেখানে বিশ্বে সংঘাত ও সহিংসতার অবসানে বড় বড় বুলি কপচাচ্ছে, সেখানে ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর বিমান হামলা তাদের কথারই বরখেলাপ। জাতিসংঘের তথ্যমতে, ইয়েমেনে এসব হামলায় এরই মধ্যে এক হাজারের বেশি লোক প্রাণ হারিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র আরও অস্ত্র বিক্রি করবে তাইওয়ানের কাছে। এই ডিসেম্বরেই দেশটির কাছে ১৮৩ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করার কথা ঘোষণা করেছে ওবামা প্রশাসন। এর মধ্যে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনকারী যুদ্ধজাহাজও রয়েছে। চীন এ ব্যাপারে তীব্র প্রতিবাদ জানালেও ওয়াশিংটন পাত্তা দেয়নি। মূলত তাইওয়ানের প্রতিরক্ষাশক্তি জোরদার করতেই যুক্তরাষ্ট্র ধাপে ধাপে এই অস্ত্র বিক্রি করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগ সংগত কারণেই চীনের সঙ্গে তাদের বৈরিতাকে উসকে দেবে। তাইওয়ানকে বরাবরই নিজের অংশ বলে দাবি করে আসছে চীন। তারা চায় না যুক্তরাষ্ট্র এতে নাক গলাক। কিন্তু ওয়াশিংটনও চায় না, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন একক আধিপত্য বিস্তার করুক। এ জন্য চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোকে সশস্ত্র সহযোগিতার মাধ্যমে ম“ দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।
এসব নানা ঘটনায় নতুন বছরে আরব বিশ্ব ও এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।
মোড়লগিরিতে যুক্তরাষ্ট্রের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়াও বসে নেই। অস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানিতে তারাও রয়েছে শীর্ষ কাতারে। ইরান, ভারত, সিরিয়া, পোল্যান্ড, ভেনেজুয়েলা ও মোজাম্বিকসহ ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে অস্ত্র রপ্তানি করে তারা। ইদানীং তাদের অস্ত্রের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষও চোখে পড়ার মতো। চীনের মতো শক্তিশালী মিত্র আছে তাদের। আছে উত্তর কোরিয়ার মতো ঘাড়ত্যাড়া বন্ধু। সিরিয়ায় বিপুল পরিমাণে অস্ত্র দিয়ে মিত্র প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে শক্ত অবস্থানে রাখতে চেষ্টার কমতি নেই পুতিনের।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এ সময়ের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা ইরানের পক্ষেও রাশিয়ার অবস্থান খুব মজবুত। ইরান তার পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাধ্যমে গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে অনেক দিন ধরেই অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের। সঙ্গে জোট বেঁধেছে পশ্চিমা রাঘব বোয়ালেরা। নানা রকম নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে আটকে ইরানকে লাগাম পরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল তারা। ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি হয়েছে, যাতে তারা পারমাণবিক অস্ত্রের দিকে যেতে না পারে। কিন্তু বাহুবল বলে কথাটা রয়েই গেছে।
সাম্প্রতিক যে জোরালো গুঞ্জন, তা হচ্ছে—রাশিয়া তাদের অগ্রবর্তী এস-৩০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রি করতে যাচ্ছে ইরানে। এই অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ইরান আকাশ পথে যেকোনো হামলা ঠেকাতে সক্ষম হবে। ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেওয়ার যে হুমকি ইসরায়েল দিয়েছিল, এই ডিফেন্স সিস্টেম এতে পানি ঢেলে দেবে। তখন ইরানকে আর পায় কে? পেছনে রাশিয়া তো আছেই।
এভাবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এটাই স্পষ্ট যে, দুয়ারে দাঁড়ানো নতুন বছরে ওবামা ও পুতিনের বাহুবল প্রদর্শন বাড়বে বই কমবে না।