খোলা বাজার২৪, বুধবার, ৬ জানুয়ারি ২০১৬: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী রাজনীতিতে পবিত্র কোরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা করেছেন। বাঙালি জাতিকে নির্মূল ও ধ্বংস করার লক্ষ্যে তিনি ইসলামিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও মহান আল্লাহর নাম এবং পবিত্র ধর্ম ইসলামকে জেনেশুনে ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপব্যবহার করেছিলেন।
নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ের ১৬০ থেকে ১৭৪ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ১৫ পৃষ্ঠাজুড়ে ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার’ শিরোনামে এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল।
রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, একাত্তরে নিজামী রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার করেছেন, পবিত্র কোরআন ও হাদিসের অপব্যাখ্যা করেছেন। তিনি ও তাঁর বাহিনী মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য আজ পর্যন্ত নিজামী কোনোদিন অনুতাপও প্রকাশ করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তুরিন আফরোজ বলেন, ‘নিজামী আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধে পরিণত করতে নানা উসকানি দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ধর্মকে ব্যবহার করেছিলেন। নোংরাভাবে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে তিনি তরুণদের উত্তেজিত করেছিলেন। চাইলেই তিনি তাঁর অবস্থান থেকে তরুণদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারতেন। তা না করে তরুণদের বিভ্রান্ত করেছেন। তিনি পাকিস্তানি সেনাদের ফেরেশতা বলে প্রচার করেন। আর এসবই ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণেও দেখানো হয়।’
ট্রাইব্যুনালের পূর্ণাঙ্গ রায়ের ১৬১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, একাত্তরের ৫ আগস্ট দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় নিজামীর একটি বক্তব্য প্রকাশিত হয়। এতে নিজামী বলেন, ‘পাকিস্তান আল্লাহর ঘর। আল্লাহ একে বারবার রক্ষা করেছেন। ভবিষ্যতেও রক্ষা করবেন। দুনিয়ার কোনো শক্তি পাকিস্তানকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না।’
ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, নিজামীর এ বক্তব্য স্পষ্টতই সুরা হজের ২৬ নম্বর আয়াতের বিকৃতি। কারণ, এই সুরায় একমাত্র কাবাঘরকে আল্লাহর ঘর বলা হয়েছে। কিন্তু নিজামী পাকিস্তানকে আল্লাহর ঘরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। নিজামী তাঁর এই বক্তব্যের মাধ্যমে ইসলামি ছাত্রসংঘের নেতাদের ভুল বুঝিয়েছিলেন। তিনি আসলে চেয়েছিলেন, ছাত্রসংঘের তরুণেরা অন্ধভাবে যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের ইসলামের শত্রু মনে করেন। জামায়াতের তখনকার আমির গোলাম আযমও (সদ্য প্রয়াত) একইভাবে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করে বক্তব্য দিতেন।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে নিজামী ইসলাম ধর্ম নিয়ে লেখাপড়া করেছেন। তিনি অনেক ইসলামি বই লিখেছেন। রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্ম বনাম ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বইয়ে নিজামী লিখেছেন, ‘আল্লাহ সব মানুষের স্রষ্টা। এর পরও কেউ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে কি আনবে না—এ ব্যাপারে তিনি স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং ঈমান আনার ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ ও জবরদস্তিকে নিষেধ করেছেন।’ মদিনা সনদের ওপর ভিত্তি করে নিজের জীবনে এমন বই লেখার পরও মুক্তিযুদ্ধকালে নিজামীর ভূমিকা ছিল পুরোপুরি বিপরীত।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, অথচ এটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়, স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধিতাকারী এমন এক ব্যক্তিকে এই রাষ্ট্রের মন্ত্রী করা হয়েছিল। তাঁকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা ছিল তৎকালীন সরকারের গুরুতর ভুল এবং মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রমহারা দুই লাখ নারীর গালে সরাসরি চপেটাঘাত। এ ধরনের লজ্জাজনক কাজ গোটা জাতির জন্য অবমাননাকর। নিজামী ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন।
ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছিলেন, মানবসভ্যতাকে নাড়িয়ে দেওয়া এসব অপরাধ করার পরও আসামিকে যদি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া না হয়, তবে এ মামলায় ন্যায়বিচার মুখ থুবড়ে পড়বে।