Wed. May 7th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

30খোলা বাজার২৪,শনিবার, ৯ জানুয়ারি ২০১৬: নামেই সিঙ্গিং-বার। আসলে গানের তালে তালে গায়িকার নাচও বাধ্যতামূলক। তা হলেই টাকা উড়তে থাকে। শালুগাড়ার এক সিঙ্গিং-বারে নেপালের এক ষাটোর্ধ্ব আপেল ব্যবসায়ী কী ভাবে সন্ধে থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ২ লাখ টাকা উড়িয়েছিলেন, সে গল্প এখনও টাটকা! পানশালার অন্দরে কান পাতলে শোনা যায়, ওই আপেল ব্যবসায়ী পছন্দের গায়িকাকে কাঠমাণ্ডু নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু, মুম্বইয়ের ডান্স-বার বন্ধ হওয়ার পরে শিলিগুড়িতে আশ্রয় নেওয়া মধ্য তিরিশের ওই মহিলার মেয়ে তখন কার্শিয়াঙের বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি। তাকে ফেলে তিনি যেতে চাননি। তাতেও ওই আপেল ব্যবসায়ী হাল ছাড়েননি। এক দিন মাটিগাড়ায় সিটি সেন্টার থেকে ওই গায়িকাকে জবরদস্তি তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন।
সে যাত্রায় সঙ্গে থাকা বাউন্সার-এর তৎপরতায় রক্ষা পেয়েছিলেন গায়িকা। পরে লাগাতার বিরক্ত করায় ওই মহিলা মেয়েকে নিয়ে শিলিগুড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। সে সময়কার ওই সিঙ্গিং-বার-এর এক ব্যান্ড মাস্টার এখন কলকাতায়। তিনি একাধিক হোটেলে গানের আসর চালান। পানশালা মহলে তিনি এমএস নামে পরিচিত। এমএস বললেন, নেপালের ওই ব্যবসায়ী একা নন, শিলিগুড়ির এক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও ওই হোটেলে হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়েন। পুলিশ-প্রশাসন, পার্টির লোকজনদের একাংশ তলে তলে একজোট হওয়ায় তা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হয়নি। এমএসের ঝুলিতে রয়েছে পানশালার গায়িকার আত্মঘাতী হওয়ার গল্পও।
সেটা অবশ্য মাটিগাড়ার একটি পানশালার ঘটনা। তা নিয়ে মামলা চলছে। সেখানেও এক প্রভাবশালী নেতার নামে নানা গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল। পুলিশের একাংশের দাবি, কোনও অভিযোগ হয়নি বলে তাঁদের পক্ষে কিছু করাও সম্ভব হয়নি। কলকাতা-শিলিগুড়িতে একযোগে একাধিক ব্যান্ডে গায়িকা জোগান দেন সিংহজি। এ নামেই পানশালার দুনিয়ায় তাঁর পসার। সেই সিংহজি বললেন, কলকাতার সঙ্গে শিলিগুড়ির মূলগত ফারাক হল, কলকাতায় নাচগান দেখার পরে বেশির ভাগ ঝুটঝামেলা কিংবা আব্দারে না গিয়ে খদ্দের বাড়ি ফিরে যান। কিন্তু, শিলিগুড়িতে একটা বড় অংশ নানা আব্দার জুড়ে দেয়। তাতে জটিলতা বাড়ে। পুলিশ আসে। সিংহজি জানান, শালুগাড়ার এক সিঙ্গিং বার থেকে এক গায়িকাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিহারের এক ডাকসাইটে ঠিকাদার ২০ জনের দল পাঠিয়েছিলেন।
তখন বেশ কয়েকটি পানশালার মালিক বাউন্সারদের একজোট করে রুখে দাঁড়ানোয় সেই ঠিকাদার নিরস্ত হন। তবে ভাড়াটে গুন্ডারা যাওয়ার আগে কয়েক জন বাউন্সারকে মারধর করেছিল। কেউ থানা-পুলিশ করেননি। কারণ! সিংহজির সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, পুলিশকে জানালে হাজারো ঝামেলা। নিজেরাই যতটা পারি মিটিয়ে নিই। কিন্তু, পুলিশকে জানিয়ে হবেটা কী! নীরস ভাবে বললেন সেই এমএস। জানালেন, এক সিঙ্গিং-বারে বিহারের এক পদস্থ পুলিশ অফিসার গিয়ে ব্যাপক গণ্ডগোল করেন। তাঁর আব্দার পানশালার গায়িকা মানতে চাননি দেখে শো বন্ধের হুমকি দেন। তখন খবর যায় জলপাইগুড়ি জেলা পুলিশের কাছে। পুলিশের অনেকেই সেখানে হাজিরও ছিলেন।
শেষ পর্যন্ত সাহেব-এর চেঁচামেচি দেখে তাঁর নিরাপত্তারক্ষীরা গিয়ে পানশালায় ব্যাপক ভাঙচুর করেন বলে অভিযোগ। শো-ও বন্ধ হয়ে যায়। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত না গড়ালেও রাজ্য পুলিশের বড়কর্তারা জানতে পারেন। সে যাত্রায় ভক্তিনগর থানার এক অফিসারকে সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয় ফলত। ঘটনাচক্রে, শালুগাড়ার সেই সিঙ্গিং-বার এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আর যে ১০-১৫টি পানশালায় গান হয়, তার মধ্যে এখন কড়াকড়ি একটু বেশিই। লাগাতার ক্লোজড সার্কিট টিভিতে বসে মনিটর করতে দেখা যায় মালিক কিংবা তাঁর খাস লোককে। কে কোন গায়িকাকে বিরক্ত করার চেষ্টা করছে বা কার আচরণে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, তা দেখে বাউন্সারদের পাঠানো হয় চটজলদি।
হিলকার্ট রোডের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে একটি ডিস্কোথেক। এক দিকে সিপিএমের জেলা অফিস। উল্টো দিকে কংগ্রেস কার্যালয়। বাদ নেই তৃণমূল নেতারাও। তা বড় নেতার আনাগোনা চলতে থাকে রাত ১০টা পর্যন্ত। ফি শনি ও রবিবার রাত ৯টা বাজলেই এলাকায় সাদা পোশাকের পুলিশে ছয়লাপ। কারণ, ডিস্কোথেক থেকে বার হওয়ার সময় সঙ্গিনী নিয়ে টানাহেঁচড়ার অভিযোগ রয়েছে। আশেপাশের হোটেল থেকেও নিরন্তর অভিযোগ যায় পুলিশের কাছে। কিন্তু, লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করলে পুলিশ কী করতে পারে! বলছেন একাধিক পুলিশ অফিসার। শাসক কিংবা বিরোধী দলের নেতাদের অনেকেই একান্তে মানছেন, শিলিগুড়ি দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে অন্যতম ট্রান্সশিপমেন্ট পয়েন্ট। সে জন্য শহরটায় যদি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকে, তা হলে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়বে।
তবে সব কিছুই সীমার মধ্যে রাখা উচিত বলে মনে করেন সকলেই। পানশালার মালিকদের সংগঠনের কর্তারা প্রায় সকলেই দাবি করেছেন, এখন পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভাল। শিলিগুড়ির সেবক রোড ও প্রধাননগরে দুটি সিঙ্গিং বার চালান, এমন একটি সংস্থার কর্ণধার বললেন, এখনকার নাইট লাইফ আগের চেয়ে অনেক আধুনিক হয়েছে বলে বিদেশি ট্যুরিস্টদেরও পানশালায় আসতে দেখি। তবে সিঙ্গিং-বার মানেই খারাপ, এমন ধারণা ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, শুধু শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়িতে সিঙ্গিং-বার-এ গান গেয়ে সংসার চালান অন্তত দেড়শো গায়িকা। কেউ বিবাহিত, কেউ কলেজে পড়েন, কেউ আবার গানের নাচগানের স্কুলও চালান। তবে শুধু সিঙ্গিং বার-ই নয়, গানের অন্য আসরও বসে শিলিগুড়িতে। সে হল গজল-সন্ধ্যা।