Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

65খোলা বাজার২৪,শনিবার,৯ জানুয়ারি ২০১৬: আলোর খোঁজ করতে গিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিলেন সাবিনা আক্তার। এখনও অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। নানা শঙ্কায় স্বজনদের থেকে আড়ালে থাকছেন। গ্রামে যান না দীর্ঘদিন। যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন সেই ব্যক্তিই তাকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। এমনকি টাকার বিনিময়ে তাকে বিক্রি করা হয়েছিল ভারতে। দুর্বিষহ সেই জীবনের গল্প জানিয়েছেন সাবিনা। তিনি জানান, যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার নিম্নবিত্ত এক পরিবারের মেয়ে সাবিনা। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি বড়। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন স্থানীয় মাদ্রাসায়। এরমধ্যেই অভাবের সংসারে আর্থিক অবদান রাখার মনস্থির করেন। ছুটে আসেন ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকার মেঘনায় খালার বাড়িতে। একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন তার খালা। ওই কোম্পানিতেই অপারেটর হিসেবে চাকরি নেন সাবিনা। তিনি জানিয়েছেন, চাকরি নেয়ার পর পরিচয় হয় ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত গাড়িচালক আরমানের সঙ্গে। মূলত বেশি বেতনে অন্য কোথাও চাকরির প্রলোভন দেখায় আরমান। এই প্রলোভনে আকৃষ্ট হন সাবিনা। এভাবে সম্পর্ক একসময় প্রেম পর্যন্ত গড়ায়। আড়াই বছর প্রেম করার পর বিয়ের প্রস্তাব দেয় আরমান। ২০১২ সালের ১৯শে জুলাই গোপনে বিয়ে করেন তারা। সাবিনা জানান, বিয়ের ওই কাগজ ছিল ভুয়া। তখন তিনি তা বুঝতে পারেননি। কাবিন ছাড়াই কোর্টে নোটারী করে একটি কাগজ তৈরি করা হয়। গোপনে কেন বিয়ে করলেন জানতে চাইলে সাবিনা জানান, তার খালা একজন বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করেছিলেন। ওই ব্যক্তি বিবাহিত ছিলেন। এতে সাবিনা তাতে অসম্মতি জানান। এসব বিষয়ে খালার সঙ্গে মনোমালিন্য হয় সাবিনার।
সাবিনা জানান, বিয়ের পর গোপনে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজীতে এক বন্ধুর ফ্ল্যাট বাসায় নিয়ে যায় তাকে। বাসায় তখন ওই বন্ধু ছাড়া আর কেউ ছিলো না। তারপরেই ঘটে জীবনের সবচেয়ে করুণ-কঠিন ঘটনা। তখন প্রায় সন্ধ্যা। পাঁচ বন্ধু প্রবেশ করে ঘরে। তখনই পাল্টে যায় আরমানের চেহারা। আরমান তাকে ডেকে নিয়ে বলে দেয়, আমার বন্ধুরা এসেছে। তারা যা চায় তাই করতে হবে।
সাবিনা জানান, প্রথমে বুঝতে পারেননি। একইভাবে দ্বিতীয়বার বললে তা শুনে অবাক হন সাবিনা। তার পুরো শরীর কেঁপে ওঠে। সাবিনা তার পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেন। এই অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে রক্ষা পেতে চান। অনুনয় করেন, আমাকে ছেড়ে দেন। আমি কাজ করে খাব। তবু এসব করতে চাই না। কিন্তু রক্ষা হয়নি। প্রাণনাশের হুমকি দেন আরমান। অবশেষে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে থাকে। রাত ৯টার পর থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত স্বামী আরমান, তার বন্ধু আনোয়ারসহ ছয় জনের ধর্ষণের শিকার হন সাবিনা। এ সময় ধর্ষণ দৃশ্যের ভিডিও চিত্র ধারণ করেন আরমান। অসুস্থ হয়ে যান সাবিনা। ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে দেন আরমান। এভাবে এক সপ্তাহের বেশি সময় ওই বাসাতে প্রতি রাতেই ধর্ষণ করা হয় তাকে। হুমকি দেয়া হয় কোথাও জানালে বা অভিযোগ করলে ভিডিও চিত্র ছড়িয়ে দেয়া হবে তার এলাকায়। এমনকি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হবে বলেও হুমকি দেয়া হয়। নিরুপায় হয়ে সবকিছু মেনে নেন সাবিনা। পরবর্তীতে সিদ্ধিরগঞ্জে একটি বাসা ভাড়া নেয় আরমান। সেখানেও জোর করে তাকে দিয়ে অনৈতিক কার্যকলাপ করানো হয়। ততদিনে মা-বাবা স্বজনরা জেনে গেছেন তার বিয়ে হয়েছে। স্বামীর সঙ্গে সুন্দরভাবেই সংসার করছে। মা-বাবা দেখতে আসেন তাকে। বাধ্য হয়েই আরমানকে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে যান।
সাবিনা জানান, শুধু ওই বাসায় নয়, তাকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যেতো আরমান। এই অনৈতিক কার্যকলাপ করে যে টাকা আয় হতো তার প্রায় পুরোটাই নিয়ে যেতো স্বামী হিসেবে পরিচিত আরমান। গাবতলীর বলাকা হোটেল, গাজীপুরের টঙ্গীর স্বাগতম, সাইনবোর্ড এলাকার হোটেল রাজধানী, কোনাবাড়ী ইয়ার ইন্টারন্যাশনাল, সিলেট, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাওয়া হতো সাবিনাকে। সাবিনা বলেন, এলাকায় আমাদের পারিবারিক সম্মান আছে। ভিডিওচিত্র প্রকাশ পেলে আত্মহত্যা ছাড়া উপায় থাকবে না। তাই বাধ্য হয়েই তার কথা শুনতে হতো। সেইসঙ্গে কিভাবে এই পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়া যায এ নিয়ে ভাবতাম। এরমধ্যেই সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করা হয় তাকে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়া হয় সেখানে। প্রায় ছয় মাস সেখাতে থাকতে হয় তাকে। সাবিনা জানান, বোম্বের পোনা এলাকার চড়ক থানার পুলিশ চৌকির ১১৪ বুধবারকেট বাড়ির সর্দার রুপা শেখ তাকে কিনে নেয়। সাবিনা বলেন, সেখানে বাংলাদেশের অনেক মেয়েকে বিভিন্নভাবে আটকে রেখে অনৈতিক কাজ করানো হচ্ছে। এই অনৈতিক কাজে ইচ্ছে না থাকলেও একসময় বাধা দেয়ার শক্তি হারিয়ে যায় বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, এই অন্ধকার জীবন থেকে বের হতে পারবো এই আশা ক্ষীণ হয়ে যায়। তখনই ঢাকার শামীম নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়। শামীম তাকে উদ্ধার করে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সাবিনাকে তিনি সাহস দেন। মামলা করার পরামর্শ দেন। বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাবে এই ভয়ে মামলা করেননি সাবিনা। তবে দেশে ফিরে আরমানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। এ নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয় দু’জনের মধ্যে। সাবিনার বাসার আসবাবপত্র ও টাকা রেখে দেয় আরমান। এসব ফেলেই নিজের জীবনকে রক্ষা করার জন্য আরমানকে ছেড়ে যান তিনি। বর্তমানে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে সোনারগাঁও এলাকায় থাকেন এই তরুণী। তার জীবনকে দুর্বিষহ করার জন্য আরমানকে দায়ী করেন সাবিনা। এ আরমানের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ থানার মহিশার গ্রামে। এসব বিষয়ে কাজ করে হিউম্যান রিসোর্স অ্যান্ড হেল্থ ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের মহাসচিব আলমগীর সেলিম বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ রয়েছে। নির্যাতিতা মামলা করতে চাইলে আমরা সহযোগিতা করবো।