খোলা বাজার২৪, বুধবার, ২০ জানুয়ারি ২০১৬ : বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে প্রকল্প নিয়ে ঘুরে বেড়ানো চীনা কোম্পানিগুলো সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
চীনা কোম্পানিগুলো রাষ্ট্রীয় হলেও তাদের আচরণ বেসরকারি কোম্পানির মতো, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পণ্য বিক্রিতে তাদেরও তৎপর- এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে নিজেদের প্রয়োজনীয়তার দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
সচিবালয়ে বুধবার নিজের দপ্তরের সম্মেলন কক্ষে সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে চীনা কোম্পানি নিয়ে এই সতর্কতা জানান মুহিত।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করেছে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক- এআইআইবি, যাকে দেখা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। গত ১৬ জানুয়ারি বেইজিংয়ে ওই ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী।
ওই অনুষ্ঠানে বয়োজ্যেষ্ঠ অংশগ্রহণকারী হিসাবে বিশেষ সম্মান পেয়েছেন বলে জানান মুহিত।
বর্তমানে চীন বাংলাদেশে খুবই সক্রিয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বিভিন্ন প্রজেক্টে তারা আগ্রহ দেখাচ্ছে। তাদের স্টেট কোম্পানিগুলো দারুণ সেলসম্যান। তারা তাদের প্রজেক্ট নিয়ে পাস করে।”
তবে ওই সব প্রকল্প গ্রহণের আগে জাতীয় গুরুত্ব বিবেচনায় সেগুলো এখন কতোটা দরকারি তা বিবেচনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “আমার সতর্ক করা উচিত। আমাদের এখানে অনেক এজেন্টরা যে প্রকল্প পারসু করছেন, সেগুলো আমরা নেব না। কারণ ইউ মাস্ট লুক অ্যাট ইউর ডিড সার্ভিসিং ক্যাপাসিটি।
“বাংলাদেশ হ্যাজ ওয়ান্ডারফুল রেকর্ড অ্যাজ ফার অ্যাজ পাবলিক ডিড। এত বছরের রেকর্ড, এটাকে ধ্বংস হতে দিতে পারি না।
“আমাদের অগ্রাধিকার অনুসারে প্রকল্প নিতে হবে। আমার অগ্রাধিকারে সেটা আছে হয়তো ১০ নম্বর। চায়না কোনো একটা পার্টি এসে সেটাকে এক নম্বরে নিতে চাইবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চীনের কোম্পানি সবই সরকারি। কিন্তু তাদের কোম্পানিগুলো প্রাইভেট কোম্পানির মতো আচরণ করে। অন্য প্রাইভেট কোম্পানির চেয়েও বরং সক্রিয়। এই মুহূর্তে তারা নানা ধরনের প্রজেক্ট নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ- আলোচনা করছে।
“আমি আমার সব কলিগদের এদের সম্পর্কে খুবই সতর্ক থাকতে বলছি। তোমার কাছে তোমার প্রকল্পের মূল্য রয়েছে। কিন্তু জাতীয় প্রেক্ষিতে এটা সর্বোচ্চ নয়। আমরা একটা প্রকল্প তালিকা দিয়েছি। এটাই আমাদের অগ্রাধিকার। এর বাইরে যেটা আসবে, সেটা করার কোনো কারণ নাই।”
চীনা কোম্পানির প্রস্তাবিত প্রকল্প সম্পর্কে মন্ত্রীর এমন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে কি না জানতে চাইলে মুহিত বলেন, “কোনো প্রভাব পড়বে না। আমি আমার স্বার্থ দেখবই। সে যেমন তার স্বার্থ দেখছে, বিক্রি করছে। আমার খরিদটা সাবধান খরিদ হওয়া দরকার। প্রযুক্তি আমি কোনখান থেকে আনব- সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
“আমার কলিগদের প্রতি আমার ইন্সট্রাকশন হলো- আপনারা ওই অগ্রাধিকার তালিকাটা ফলো করবেন। আলোচনা করেন, কারণ আজ আলোচনা করলে সেটা হয়তো ৫ বছর পর অগ্রাধিকারে চলে আসবে। তিন বছর পর হয়তো আমরা আরেকটা অগ্রাধিকার তালিকা করতে পারি।”
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, রেল ও অবকাঠামো খাতে হাজার কোটি ডলারের বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়নের প্রস্তাব রয়েছে চীনের। চীন সরকার ছাড়াও দেশটির কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কোম্পানি বাংলাদেশ সরকারের কাছে এসব প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
চীন বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটার পর একটা প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছে বলে গত জুনে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব আসিফ-উজ- জামান জানিয়েছিলেন।
ইআরডির প্রতি অসন্তোষ অর্থমন্ত্রীর
এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সদস্য হিসাবে অংশ নিতে না পারায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন মুহিত।
এজন্য বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ- ইআরডিকে দুষছেন তিনি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমার একটা খেদ আছে। সভায় ২০টি দেশ সদস্য হিসাবে ছিল। বাকিরা পর্যবেক্ষক এবং সদস্য হতে চাওয়া রাষ্ট্র হিসাবে অংশ নিয়েছে। আমার খেদটা হলো- আমাদের ইআরডি আরেকটু ভিজিলেন্ট হলে আমরাও সদস্য হতে পারতাম।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে। তবে সদস্য হওয়ার জন্য রেটিফিকেশন প্রয়োজন।
“সংসদীয় আইন আমাদের তৈরি আছে, কিন্তু গত অধিবেশনে সেটা পাস হয় নাই। সেই আর্জেন্সি আমরা জানতাম না। দ্যাট ওয়াজ দ্যা নেগ্লেক্ট।”
‘অনুষ্ঠানের হিরো বাংলাদেশি কর্মকর্তা’
এআইআইবির বিভিন্ন সভায় ইআরডির অতিরিক্ত সচিব আসিফুজ্জামানের কাজ সবার দৃষ্টি কাড়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী।
“প্লেজারটা হলো- আমাদেরই একজন আসিফুজ্জামান। হি ওয়াজ দ্য হিরো অব দ্য কনফারেন্স। সে সকল প্রিপারেটরি কমিটির মিটিংয়ে অংশ নিয়েছে। চাইনিজদের বাইরে একমাত্র সে সকল মিটিংয়ে অংশ নিয়েছে।
“চার্টার, রুলস, রেগুলেশন- সবগুলোতেই সে কন্ট্রিবিউট করেছে। কোনো কিছু হলেই তাকে জিজ্ঞেস করত- এটা কী হচ্ছে? সে আমাদের জন্য গর্ব। তাকে মন্ত্রী ডাকতেছে, ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডাকতেছে, সবাই ডাকতেছে। এটা বাংলাদেশের জন্য সম্মান।”
এই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ হলে বাংলাদেশ তাকে পরিচালক করবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকলেও চীন বাংলাদেশকে সম্মান করেছে বলে মন্তব্য করেন মুহিত।
“এক নম্বরে আসিফ। আর আমি সেখানে উপস্থিত সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলাম। আমাকে বিশেষভাবে সম্মান দেখিয়েছে। উভয় সেশনে আমি প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের পাশেই ছিলাম।”
‘বিত্তশালী চীন থেকে এআইআইবি’
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের লক্ষ্য নিয়ে এআইআইবির আত্মপ্রকাশকে চীনের বিত্তশালী হয়ে ওঠার প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী।
এ সম্পর্কে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্ব বাস্তবতায় অর্থনৈতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ তুলেছেন তিনি।
এক সময় বিশ্ব ব্যাংকে কাজ করে আসা মুহিত বলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও চীন সিদ্ধান্ত নেয় যে, প্রথম মহাযুদ্ধের পর নেওয়া ব্যবস্থা ছিল আনজাস্ট। সেটা জার্মানিকে শাস্তি দেয়, যার ফলে শান্তিচুক্তি কাজে আসেনি।
“সে সময় একমাত্র উদ্বৃত্ত দেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্র। বাকি সবার ঘাটতি ছিল, সবারই যুক্তরাষ্ট্র থেকে সহযোগিতা দরকার ছিল। এমনকি সোভিয়েত রাশিয়ারও সাহায্যের দরকার ছিল।
“সেই ব্যবস্থায় আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় ক্ষমতা থাকে।”
রাশিয়া জাতিসংঘে যোগ দিলেও আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে অংশ নেয়নি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, “সেই সময় একটা মৌলিক ব্যাপার ছিল- বিত্তশালী দেশই অন্যদেরকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে।
তবে এবারেরটা (এআইআইবি) যুদ্ধ শেষ হওয়ার ব্যাপার নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এটা কেবল চীন নিজেদের একটা বিত্তশালী দেশ হিসাবে গড়ে তুলেছে বলে হয়েছে।”
“আশির দশকের শেষের দিক থেকে এই সময় পর্যন্ত মূলত তারা বিত্তের মালিক হয়েছে। তারা মনে করেছে, বিত্তশালী দেশ আমেরিকা পৃথিবীর সাহায্যে এসছিল, আমরাও একটু করি। সেটা তারা করেছে, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক।”
বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর এই অভিমত অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের কাছ থেকেও এসেছে।
ব্যাংকটি উদ্বোধনের দিন লুক্সেমবার্গের অর্থমন্ত্রী পিয়েঁ গামেইয়া বলেন, এআইআইবির প্রতিষ্ঠা ‘বিশ্ব অর্থনীতির পুনঃভারসাম্যের আরও একটি দৃষ্টান্ত।”
ওয়াশিংটনের বিরোধিতা সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, জার্মানি, ইতালি, ফিলিপিন্স ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মিত্র দেশ এই ব্যাংকে যোগ দিতে সম্মতি জানিয়েছে। চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সক্ষমতার স্বীকৃতি হিসেবে তাদের এই অবস্থানকে দেখা হচ্ছে বলে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়।