খোলা বাজার২৪, সোমবার, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ : গাছে গাছে তাবিজ। ঘরে তাবিজ। উঠানে তাবিজ। মাঠে তাবিজ। পুকুরে তাবিজ। মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে তাবিজ। তাবিজ ঝুলছে সবার গলায়, হাতে আর কোমরে। আগুনের হাত থেকে পরিবার আর ঘর রক্ষার জন্যই তাবিজের আশ্রয় নিয়েছে একটি পরিবার। তবু আগুন তাদের পিছু ছাড়ছে না। প্রতিদিন ঘরের চালা, বেড়া, আসবাব—কোথাও না কোথাও আগুন ধরে উঠছে। এমনকি পুকুরে ভিজিয়ে রাখা কাপড়েও আগুন জ্বলে উঠছে।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের শিবা গ্রামের কৃষক মোস্তফা বেপারীর বাড়িতে গত ২৪ দিনে শতাধিকবার আগুন লেগেছে কোথাও না কোথাও। সে কথা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। সে কারণে বাড়িটি দীর্ঘদিনের পরিচয় হারিয়ে ‘আগুনবাড়ি’ পরিচয় পেয়ে গেছে। বাড়িটি একনজর দেখতে সবাই ছুটছে। প্রতিদিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা আগুনবাড়ির পথে দেখা যায় মানুষের স্রোত। গ্রামের এত দিনের নীরব সড়ক হঠাৎই ব্যস্ত রাজপথের মতো হয়ে গেছে। মানুষের ভিড়ে মোস্তফা বেপারীর বাড়ি ও আশপাশের কয়েকটি বাড়ির মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এমন আগুন নিয়ে নানা কুসংস্কারের কারণে গ্রামবাসীর মধ্যে উদ্বেগ আর আতঙ্ক রয়েছে। মোস্তফা বেপারীর পরিবারকেও সামাজিকভাবে অনেকটা কোণঠাসা করে দিয়েছে এই কুসংস্কার। তাই তো তিনি রহস্যময় আগুনের এই উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র কোনো কিছুই বাদ রাখেননি। ৪০ জনকে দিয়ে কোরআন খতম করিয়েছেন। অন্তত দেড় ডজন সাধককে ডেকে তদবিরও (দাওয়াই) নিয়েছেন। কিন্তু কোনোটাতেই কিছু হয়নি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উত্তর শিবা গ্রামের মুখারবান্দা খালের পশ্চিম পাড় ঘেঁষে মোস্তফা বেপারীর বাড়ি। ১৫ বছরের পুরনো এই ভিটার পূর্বে ও উত্তরে দুটি চৌচালা (বড়) টিনের ঘর। পূর্ব ভিটার ঘরটি পুরনো। তবে উত্তর ভিটার ঘরটি নতুন। পুরনো ঘরটিতেই ১৫ বছর ধরে পাঁচ ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে মোস্তফা বেপারীর পরিবারের বসবাস। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছেন। ছেলেরা রাজমিস্ত্রিসহ বিভিন্ন পেশায় দিনমজুরি করেন। ছেলেরা সবাই বিয়ে করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন একমাত্র মেয়েকেও। বড় সংসারের বাড়তি লোকের চাপ সামলাতে ওই বাড়ির উত্তর ভিটায় এক বছর আগে নতুন করে আরো একটি চৌচালা টিনের ঘর তোলেন তাঁরা। আগুনের কারণে ঘরে বেড়াগুলো খুলে বাগানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। ঘরের সব মালামাল বাগানে এখানে সেখানে ফেলে রাখা হয়েছে। যেখানে মালামালগুলো রাখা হয়েছে, সেখানেই আগুন ধরে উঠছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা সাংবাদিকদের জানিয়েছে। আসবাব ও ঘরের অংশবিশেষে আগুনে পোড়ার দাগ রয়েছে।
কয়েক দিন আগে হঠাৎ জ্বলে ওঠা আগুন নেভাতে গিয়ে প্রতিবেশী ইউসুফ আলী, আব্দুল আলীম, মিজানুর রহমান, ফরিদ আহমেদ, আলাউদ্দিন ও মাইনউদ্দিন আহত হয়েছেন। তাঁদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে সাংবাদিকদের কথা হয়েছে। তাঁরা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। বাড়ির কর্তা মোস্তফা বেপারী বলেন, গত বছর জানুয়ারির প্রথম দিকে নতুন এই টিনের ঘর তোলার পর থেকে পুরনো ঘরে ‘রহস্যঘেরা’ আগুনের উপদ্রব শুরু হয়। তখন জৌনপুরী পীর সাহেবের কাছ থেকে নানা তদবির (দাওয়াই) দেওয়ার ১৫ দিন পর সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি আবার নতুন করে সমস্যা দেখা দেয়। ওই দিন সকালে হঠাৎ করে পূর্ব ভিটার পুরনো ঘরের চালার টিনে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। তাঁরা আগুন নিভিয়ে ফেলেন। এর পর থেকে গত ২৪ দিনে নতুন ও পুরনো দুটি ঘরের টিন, চালা, বেড়া, ঘরে রাখা চাল, তরকারি, লেপ-কাঁথা, আসবাব, জামাকাপড় সব কিছুতেই আগুন ধরে উঠছে। এমনকি পুকুরে ভিজিয়ে রাখা জামাকাপড়-কাঁথায়ও আগুন ধরে উঠছে। আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইসমাইল হোসেন রাসেল বলেন, সকাল-বিকাল নয়, যেকোনো সময়ই বাড়িতে অলৌকিকভাবে আগুন জ্বলে উঠছে। এমনকি আগুনে মালামাল পুড়েও যাচ্ছে। বিষয়টি তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করেছেন। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী মানুষের নিরাপত্তার জন্য বাড়িতে চৌকিদারদের সার্বক্ষণিক পাহারা বসানো হয়েছে।
চরফ্যাশন থানার ওসি এনামুল হক জানান, আগুন নিয়ে গ্রামজুড়ে হইচই পড়ার খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছিল। আগুন লাগার প্রমাণ পাওয়া গেছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওই পরিবার ও উৎসুক মানুষের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইসমাইল হোসেন রাসেল তাঁকে ফোনে বিষয়টি জানিয়েছেন। বিষয়টি গুজব, না বাস্তব সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক আ ক ম মোস্তফা জামান বলেন, ঘটনার বর্ণনা অনুযায়ী বাড়িটি খালের পাড় ঘেঁষে। ধারণা করা হচ্ছে, বাড়িটির ওই স্থান একসময় খাল আর পাশে গাছ ছিল। সেখানে গাছ মাটির নিচে চাপা পড়ে মিথেন গ্যাস তৈরি হয়েছে। যখনই বাতাস বইছে, তখনই মিথেন গ্যাসের ঘর্ষণে আগুন জ্বলে উঠছে। সাধারণত শীত মৌসুমে এই আগুন দেখা যায়। এই শিক্ষক আরো বলেন, ‘কিতাবের ভাষায় এটি ভূতের আলো বা আলেয়ার আলো নামে পরিচিত। তবে ভূতের আলোতে আসবাবপত্র পুড়ে যাওয়ার কথা নয়।