খোলা বাজার২৪, বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬: রাজধানীর শাহজাহানপুরে রেলওয়ের পানির পাম্পের পাইপে পড়ে শিশু জিহাদের মৃত্যুর ঘটনায় হওয়া মামলাটি তুলে নিতে পরিবারের ওপর এবার খোদ স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার চাপ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
জিহাদের পরিবারের অভিযোগ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার হামিদুল হক শামীম গতকাল মঙ্গলবার রাতে মামলার এক আসামির মাধ্যমে জিহাদের বাবাকে তাঁর কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে যান। তারপর জোর করে একটি স্ট্যাম্পে তাঁর স্বাক্ষর নেন তিনি। মামলা তুলে নিলে তিনি আসামিদের কাছ থেকে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা নিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন। বিষয়টি থানা বা অন্য কাউকে জানালে তাঁদের এলাকা ছাড়া করারও হুমকি দেন ওই কমিশনার।
তবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনার হামিদুল তা অস্বীকার করেন। কিন্তু জিহাদের বাবাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া মামলার আসামি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে কমিশনার জিহাদের বাবাকে ডেকে নিয়েছেন। কোনো ভয়ভীতি বা হয়রানির কোনো কিছু করা হয়নি।
২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর শাহজাহানপুরের রেলওয়ে কলোনি এলাকায় গভীর পাইপে পড়ে যায় শিশু জিহাদ। পরের দিনদুপুরে কয়েকজন যুবক চেষ্টা চালিয়ে শিশু জিহাদকে উদ্ধার করে। গণমাধ্যমের কল্যাণে এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়।
ছেলে জিহাদের মৃত্যুর ঘটনায় অবহেলার অভিযোগ এনে বাবা নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে ওই পানির পাম্প বসানোর প্রকল্প পরিচালক রেলওয়ের জ্যেষ্ঠ উপসহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেএসআর-এর মালিক প্রকৌশলী আবদুস সালামের বিরুদ্ধে শাহজাহানপুর থানায় মামলা করেন। গত বছরের ৭ এপ্রিল এ দুজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। কিন্তু আরও কয়েকজন আসামির নাম বাদ পড়ায় জিহাদের বাবা অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দেন। নারাজিতে আবু জাফর, সাইফুল ইসলাম, দীপক বাবু ও নাসির উদ্দিন নামের রেলওয়ের চার কর্মকর্তাকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়ার আবেদন করা হয়। শিশু জিহাদের মৃত্যুর ঘটনাস্থল ওই পানির পাম্প স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণে এ চারজনেরও অবহেলা ছিল বলে নারাজিতে বলা হয়। পরে আদালতের নির্দেশে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) মামলাটি পুনঃতদন্তের দায়িত্ব পায়।
জিহাদের বাবা অভিযোগ করেন, গতকাল রাত আটটার দিকে মামলার আসামি জাহাঙ্গীর তাঁর বাসায় আসেন। জাহাঙ্গীর তাঁকে জানান, কমিশনার হামিদুল হক শামীম তাঁকে তাঁর কার্যালয়ে ডেকেছেন। তিনি তাঁর সঙ্গে কমিশনারের কার্যালয়ে যান। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন, মামলার সব আসামি ছাড়াও বেশ কয়েকজন যুবক অবস্থান করেছেন। কমিশনার তাঁর দিকে একটি স্ট্যাম্প এগিয়ে দিয়ে সেখানে সই করতে বলেন।
জিহাদের বাবা নাসিরের ভাষ্য, ‘আমি বললাম, আমি সই করুম না। কমিশনার সাব ধমক দিয়া কইল, “তোর বাপ করব।” সই ছাড়া আমারে কমিশনার অফিস থেইকা বাইর হইতে দিতেছিল না। তারপর চাপের মুখে পইড়া আমি সই করি। রাত সাড়ে ১০টার দিকে আমারে ছাড়ে। স্ট্যাম্পে হাতে কী লেখা ছিল, আমি পড়তেও পারি নাই। তাই সেখানে কী লেখা ছিল, তা আমি জানি না। তবে বাইর হওয়ার আগে কমিশনার ও কয়েকজন আসামি আমারে কইল, জিহাদের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা আপস করলে আমারে তাঁরা পাঁচ-ছয় লাখ ট্যাকা দিব।’
নাসির আরও অভিযোগ করেন, আজ বুধবার সকালে তিনি এ বিষয়টি নিয়ে শাহজাহানপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লোক মারফত কমিশনার খবর পাঠিয়েছেন, থানায় গেলে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হবে। এলাকা ছাড়া করা হবে। আগেও আসামিরা বিভিন্ন লোক মারফত মামলা তুলে নিতে বিভিন্ন চাপ ও হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু তিনি কখনো ভড়কে যাননি। তবে এবার খোদ কমিশনার আসামিদের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। তাই তিনিসহ পুরো পরিবারই আতঙ্কে আছেন বলে জানালেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনার হামিদুল বলেন, ‘জিহাদের বাবাকে আমার কার্যালয়ে আনা হয়নি। কোনো সইও নেওয়া হয়নি। এ অভিযোগ মিথ্যা। তবে শুনেছি, আসামিরা একটা আপসে যেতে চাচ্ছেন।’ তাহলে আপনার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ কেন—প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না।’
কমিশনার অভিযোগ অস্বীকার করলেও জিহাদের বাবাকে তাঁর কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে যাওয়া মামলার আসামি জাহাঙ্গীর বলেন, ‘কমিশনার জনপ্রতিনিধি হিসেবে জিহাদের বাবাকে ডেকেছেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনিও চান, এ ঘটনা মীমাংসা হোক। তাই তিনি হয়তো স্ট্যাম্পে সই নিয়েছেন। তবে কোনো ভয়ভীতি, হুমকি বা কাউকে হয়রানি করার কিছু ঘটেনি।’ তাহলে স্ট্যাম্পে কী ছিল—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা কমিশনার জানেন।’ তাঁর দাবি, ‘ওই পানির পাম্পের কাজের সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম না। অথচ আমি এক বছর ধরে এ ঘটনার ভুক্তভোগী হচ্ছি।’
যোগাযোগ করা হলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাকে জিহাদের বাবা ফোন করে এসব অভিযোগ করেছেন। আমি তাঁকে থানায় জিডি করতে পরামর্শ দিয়েছি।’ কিন্তু ভয়ে জিহাদের বাবা জিডি করতে পারছেন না—এ ব্যাপারে এসআই মিজানুর বলেন, ‘তাহলে তিনি পরবর্তী তারিখে আদালতে বিষয়টি জানাক। আর আমি মামলার তদন্ত প্রায় শেষ করে এনেছি। অচিরেই অভিযোগপত্র দিয়ে দেব। আমার কাছে কোনো আপস-টাপসের গুরুত্ব নাই।