খোলা বাজার২৪, শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬: হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের চার শিশুকে হত্যা করা হয়েছে তাদের পরিবারের ওপর ক্ষোভ ও পঞ্চায়েতের দ্বন্দ্বের কারণে। হত্যায় সরাসরি অংশ নেয় ছয়জন। শিশুদের প্রথমে অচেতন করা হয় এবং পরে শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃত রুবেল মিয়ার (১৮) স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে এই তথ্য জানা গেছে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় তিনি হবিগঞ্জের বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক কৌশিক আহমদ খোন্দকারের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়।
তবে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র বলেছেন, রুবেলের জবানবন্দিই এ মামলার চূড়ান্ত কিছু নয়। তিনি অনেক কিছু আড়াল করতে পারেন এবং নিজের পরিবারের সদস্যদের রক্ষার চেষ্টাও তাঁর থাকতে পারে। তবে এই জবানবন্দি থেকে পুলিশ হত্যার বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা পেয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।
রুবেলের জবানবন্দি অনুযায়ী, এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে মুখ্য ভূমিকায় ছিল গ্রামের অটোরিকশাচালক বাচ্চু মিয়া। শিশুদের পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের ওপর তাঁর ক্ষোভ ছিল। পুলিশ বলেছে, বাচ্চু মিয়াকে তারা গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তাঁর পরিবার দাবি করেছে, গত বুধবার র্যাব তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে। র্যাব অবশ্য এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হয়নি।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছেন। এঁরা হলেন আবদুল আলী, তাঁর দুই ছেলে জুয়েল (২০) ও রুবেল (১৮) এবং গ্রামের আরজু ও বশির। আবদুল আলী গ্রামের বিভক্ত পঞ্চায়েতের এক পক্ষের নেতা।
রুবেলের জবানবন্দি দেওয়ার পর রাত সাড়ে আটটায় হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র তাঁর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। রুবেলের জবানবন্দির তথ্য উদ্ধৃত করে পুলিশ সুপার বলেন, হত্যাকাণ্ডটি ছিল পরিকল্পিত। হত্যাকাণ্ডে ছয় ব্যক্তি সরাসরি অংশ নেন। আরও কয়েকজন তাঁদের সহযোগিতা করেন।
এসপি বলেন, ১২ ফেব্র“য়ারি বিকেলে চার শিশু ভাদেশ্বর গ্রামে খেলা দেখতে যাওয়ার বিষয়টি গ্রেপ্তারকৃত আরজু ও অটোরিকশাচালক বাচ্চু দেখতে পান। এরপরই বাচ্চু তাঁর অটোরিকশা নিয়ে ভাদেশ্বর-সুন্দ্রাটিকি সড়কের মাঝামাঝি এক জায়গায় অপেক্ষায় থাকেন। সন্ধ্যার আগে চার শিশু তাজেল, মনির, জাকারিয়া ও ইসমাইল হেঁটে বাড়ির দিকে রওনা হয়। তারা অটোরিকশাটির কাছে এলে বাচ্চু তাদের বাড়িতে নামিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। পূর্বপরিচিত হওয়ায় শিশুরা তাঁর অটোরিকশায় ওঠে। অটোরিকশার ভেতরেই শিশুদের চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে অচেতন করা হয়। পরে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বাচ্চুর অটোরিকশার গ্যারেজে। গ্যারেজটি বাচ্চুর বাড়ির ভেতরে। সেখানে রুবেল, বাচ্চু, আরজুসহ ছয়জন মিলে তাদের একে একে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। পরে আরও কয়েকজনের সহযোগিতায় তাদের ওই রাতেই গ্রামের বালুছড়ায় মাটিচাপা দেওয়া হয়।
রুবেল তাঁর জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, বাচ্চু ও আরজু বিভিন্ন সময় নিহত শিশুদের পরিবারের সদস্যদের দ্বারা অপমানিত হয়েছেন। বাচ্চুর অনেক ক্ষোভ ছিল। এ ছাড়া গ্রামে পঞ্চায়েত নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। একটি পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আবদুল খালেক মাস্টার (৭৫)। তিনি গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। নিহত শিশুদের পরিবারগুলো ছিল আবদুল খালেক মাস্টারের সমর্থক। অপর পক্ষে আবদুল আলী (৬০)। তিনি স্থানীয় ফয়জাবাদ চা-বাগানের পাহারাদারের চাকরি করতেন। সম্প্রতি একটি বরইগাছ কাটাকে কেন্দ্র করে এ দুই পক্ষের বিরোধ চাঙা হয়। ওই পক্ষকে দুর্বল করতে শিশুদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
পুলিশ সুপার বলেন, অটোরিকশা গ্যারেজ থেকে রক্তমাখা একটি পাঞ্জাবি, একটি শাবল, বস্তাসহ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কিছু আলামত উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার আবদুল আলী ও জুয়েল ১০ দিনের রিমান্ডে আছেন। গতকাল আরজু ও বশিরকে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে হাজির করে পুলিশ। পরে এ বিষয়ে আদেশ দেবেন আদালত।
বাচ্চু মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, ‘সে আমাদের কাছে নেই।’
বাচ্চুর পরিবার দাবি করেছে, গত বুধবার রাতে র্যাবের একটি দল বাচ্চুকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের অধিনায়ক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বাহুবলের ঘটনাটি খুবই স্পর্শকাতর। তাঁরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। তবে কোনো ধরনের অগ্রগতি না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারছেন না। অগ্রগতি হলে পরে গণমাধ্যমকে জানাবেন।
রুবেলের জবানবন্দির তথ্য জানিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে নিহত তাজেলের বাবা আবদুল আজিজ বলেন, ‘রুবেল সবার নাম বলেনি। অনেক কিছু আড়াল করেছে। কারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, সুন্দ্রাটিকির সবাই তা জানেন।’
মামলার বাদী নিহত মনিরের বাবা আবদাল মিয়া বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমাদের ধারণা সত্যি হলো। বাচ্চারা নিখোঁজ হওয়ার পরপরই আমরা আবদুল আলী ও তাঁর লোকজনের সম্পৃক্ততার কথা পুলিশকে জানিয়েছিলাম। কারণ, গ্রামের আহাদ মিয়া বাচ্চুর অটোরিকশায় চার শিশুকে দেখেছিলেন। এটাও পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশ যদি আমাদের কথায় গুরুত্ব দিয়ে দেখত, তাহলে হয়তো শিশুরা বেঁচে যেত।’
বাহুবল থানা-পুলিশের গাফিলতির বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’ কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে কি না—জানতে চাইলে তিনি তা এড়িয়ে যান।