খোলা বাজার২৪ মঙ্গলবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার পরপরই ‘ভিক্ষুক পুনর্বাসন’ কার্যক্রমে নতুন করে তৎপরতা শুরু হয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ বিষয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গত ২ জানুয়ারি জাতীয় সমাজসেবা দিবস ও সমাজসেবা সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ভিক্ষুক ও ছিন্নমূল মানুষদের সরকারের তরফ থেকে বিনা খরচে পুনর্বাসন করা হবে বলেও উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ দেওয়ার আগে ২০১০ সাল থেকেই সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ শীর্ষক কর্মসূচি পরিচালনা করছিল। এ কর্মসূচি পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়ে। এখন আবার এ কর্মসূচিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পসহ অন্যরাও কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে।
ভিক্ষুক পুনর্বাসনের বিষয়টি বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছে। গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর সিলেটে এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, দেশে কোনো ভিক্ষুক নেই বলে এবারের বাজেটে ভিক্ষুক পুনর্বাসনের জন্য কোনো বরাদ্দ রাখতে হয়নি।
অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে এখন আর কোনো ভিক্ষুক নেই। যারা ভিক্ষুক ছিল, তাদের পুনর্বাসন করা হয়েছে। আমি অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর গত ছয়টি বাজেটে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ রাখতাম। কিন্তু এবারের বাজেটে কোনো বরাদ্দ রাখিনি। শহরের রাস্তাঘাটে কিছু ভিক্ষুক দেখতে পাবেন। এরা চরিত্রগতভাবে ভিক্ষুক। এদের রাজবাড়ি বানিয়ে দিলেও ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়বে না। তাদের পেশাই হলো ভিক্ষাবৃত্তি।’
অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। কেননা প্রধানমন্ত্রী নিজে ভিক্ষুক পুনর্বাসনের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ কর্মসূচির আওতায় ঢাকা শহরে ১০টি বেসরকারি সংগঠনের সহায়তায় ভিক্ষুক জরিপে ১০ হাজার ভিক্ষুকের ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করে ডেটাবেজ তৈরি করা হয়।
জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৮০ দশমিক ৪৮ শতাংশ নিজ জেলায় পুনর্বাসনে এবং ৯৩ শতাংশই সরকারের সহায়তা পেলে ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দেবে বলে জানায়। ১০ হাজার ভিক্ষুকের মধ্যে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু ভিক্ষুকের সংখ্যা ছিল ১০ শতাংশ। এদের প্রাথমিক ও কারিগরি শিক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। অন্যদের নারী, পুরুষ, প্রতিবন্ধীসহ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন করার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে এসবের কিছুই হয়নি। কর্মসূচিতে কাগজে-কলমে ময়মনসিংহ এবং জামালপুরে ৬৬ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করা হয়েছে। গত বছরে ১৫৭ জনকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে সরকারের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। তবে যাঁদের পুনর্বাসন করা হয়েছিল, তাঁরা আদৌ ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিয়েছেন কি না, সে তথ্য নেই সমাজসেবা অধিদপ্তরের কাছে। বর্তমানে আবার রাস্তায় থাকা ব্যক্তিদের ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচিতে এ পর্যন্ত বাজেটে প্রায় ২০ কোটি টাকার বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। অর্থছাড় করা হয় ১২ কোটি টাকার বেশি। তবে জরিপ, আসবাব কেনা, ময়মনসিংহ ও জামালপুরে কিছু কার্যক্রম পরিচালনা বাবদ মোট খরচ হয়েছে এক কোটি টাকারও কম। গত দুই অর্থবছরে এ কর্মসূচির আওতায় বলতে গেলে কোনো কার্যক্রম হয়নি। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ এসে ঠেকেছে ৫০ লাখে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ নূরুল কবির প্রথম আলোকে জানালেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর ভিক্ষুক ও ভাসমান পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের বিষয়টি ঢেলে সাজানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘প্রকৃত অর্থে দেশে কোনো ভিক্ষুক নেই। সব শখের ভিক্ষুক। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কাউকে ভিক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। ছয় তালা ভবনের মালিকও ভিক্ষা করে।’
চলতি অর্থবছরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ‘যার জমি আছে ঘর নাই তার নিজ জমিতে ঘর নির্মাণ’ উপখাতের আওতায় নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ভিক্ষুকদের জন্য ১৫টি ঘর তৈরির জন্য ১১ লাখ ২৫ হাজার টাকা অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক জহিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের সহায়তায় পর্যায়ক্রমে দেশের সব উপজেলায় শতভাগ ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন করা হবে। প্রাথমিকভাবে আটটি উপজেলার মধ্যে কিশোরগঞ্জ উপজেলায় কাজের আওতায় ১০টি ঘর তৈরি সম্পন্ন হয়েছে। ৫০টি ঘর তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। এ উপজেলায় ভিক্ষুক আছে মোট ৯৫১ জন।
গত ২৪ জানুয়ারি পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এ প্রকল্পের আওতায় দেশব্যাপী ভিক্ষুক ও দরিদ্র পরিবারের তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে। এক অঞ্চলের ভিক্ষুক অন্য অঞ্চলে ভাসমান অবস্থায় থাকে বলে তাদের স্থায়ী ঠিকানায় গিয়ে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ ধরনের ভাসমানদেরও পুনর্বাসন করা হবে। প্রকৃত ভিক্ষুকদের নাম তালিকাভুক্তির জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে। এতে প্রকল্পের উপজেলা কার্যালয় ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে সহায়তা করতে নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।