Sat. May 3rd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

17kখোলা বাজার২৪ শনিবার,২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬: আমেরিকায় বেড়ে ওঠা তৃষা আহমেদ যখন ষষ্ঠ গ্রেডের ছাত্রী, তখন অভিজিৎ রায় তার জীবনে আসেন ‘বাবা’ হয়ে। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী কম্পিউটার প্রকৌশলী অভিজিৎ গতবছর স্ত্রী বন্যা আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। ফেব্র“য়ারির এই দিনটিতেই বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঘাতকের হামলায় খুন হন মুক্তমনা এই লেখক। তৃষার মা বন্যা আহমেদও ওই হামলায় আহত হন। মায়ের মতো তৃষাকেও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ২৬ ফেব্র“য়ারির স্মৃতি। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর বছরপূর্তিতে সিএনএন-এ প্রকাশিত এক বিশেষ নিবন্ধে তৃষা সামনে নিয়ে এসেছেন অন্য এক অভিজিৎ রায়কে। ডায়েরির ঢঙে লেখা এই নিবন্ধে জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তৃষা লিখেছেন, বাবা তাকে নির্ভীক চিত্তে সত্যের পথে হাঁটতে শিখিয়ে গেছেন। সিএনএনএর ইংরেজি নিবন্ধ থেকে তৃষার জবানীর বাংলা তর্জমা, পাঠকদের জন্য।
উনাকে বাবা ডাকতে কেমন যেন লাগলো কয়েক দিন। উনার রসবোধ আর ভাবভঙ্গি বাবার চেয়ে আঙ্কেলদের সঙ্গেই বেশি মেলে। সিক্সথ গ্রেড শেষ হওয়ার পরের গ্রীষ্মে আমরা নতুন বাড়িতে উঠলাম। উনি লম্বা দুটো লাঠি নিয়ে উঠানে এলেন। একটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন- ‘আয় তলোয়ার ফাইট!’ আমিও সানন্দে রাজি। বললাম, “তোমাকে আমি হারাবোই।” সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত সেদিন আমাদের লড়াই চললো। প্রতিবারই আমি হারলাম। প্রতিবার হারার পর আবার খেলার জন্য জেদ ধরছিলাম আমি। তারপরও প্রতিবারই হারছিলাম। উনাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম- কেন সেদিন আমাকে একবারও জিততে দেননি। উত্তরে বলেছিলেন, “আমি তোকে আমার সমান মনে করি- তুই কি তা চাস না?” দিনের বেলায় বাবা থাকতেন একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামার। আর বাসায় ফিরে হয়ে যেতেন লেখক। সমকামিতা নিয়ে বিজ্ঞান কী বলে, ধর্মীয় উগ্রবাদের ভাইরাস কতোটা ভয়ঙ্কর- সে কথা তিনি বইয়ে লিখেছেন। তিনি চাইতেন, বাংলাদেশের মূলধারায় ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে আরও বেশি আলোচনা হোক। এ কারণে অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে দিন দিন আরও বেশি পরিচিত হয়ে উঠছিলেন। আমার ইলেভেন্থ গ্রেডের পরীক্ষার মাত্র এক মাস আগে আমাদের ক্যালকুলাস শিক্ষক চাকরি ছেড়ে দিলেন। বললেন, স্কুলের বেতনে তার আর চলছে না।
বাবার সাথে আমি একটা চুক্তিতে আসলাম। উনি আমাকে ক্যালকুলাস আর ফিজিক্স পড়াবেন, বিনিময়ে আমি উনার লেখা অনুবাদে সাহায্য করব। আমি মাঝে মধ্যে বলতাম, “বাবা, এরকম জঘন্য বাক্য তুমি কীভাবে লেখ! গ্রামারের এ কী অবস্থা!” “তৃষা, দয়া করে ঠিক করে দে। অনুবাদ যেমনই হোক, বিষয়টা ভালো,” বলতেন বাবা। বাবার লেখাগুলো সত্যিই ভালো ছিল। খুব ভালো কাজ করছিলাম আমরা। প্রতি ফেব্র“য়ারিতে ঢাকায় জাতীয়ভাবে একটা বইমেলা হয়। বাংলাদেশে ওটাই আমার বাবা-মায়ের শহর। ঢাকার পথে রওনা হওয়ার আগে ওরা বাল্টিমোরে জনস হপকিনসে এলেন আমাকে দেখতে। এ বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন আমি পড়ছি। আমার জন্য বাক্স ভর্তি উপহার এনেছিল ওরা। ক্যান্ডি, জামা, নোটবুক, কলমৃ। ওদের কিছু দিতে পারিনি বলে আমার খারাপ লাগছিল। ব্যাগপ্যাকে দুটো স্কার্ফ ছিল, বের করে দুজনকে তাই দিলাম। বাবা সারা রাত ওই স্কার্ফ পরে ছিলেন।
২৬ ফেব্র“য়ারি (সকাল)
তখন সাড়ে ১০টা। কগনিটিভ নিউরোসায়েন্সের ক্লাস। ৩০০ জনের লেকচার থিয়েটারের শেষ সারিতে বসেছি। দুপুরে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনটা মেসেজ, ঢাকা থেকে কাজিনরা পাঠিয়েছে। মেসেজ পড়ে আমার গাল বেয়ে চোখের পানি নামতে লাগলো। আমি কাঁপছিলাম। কী করবৃরুমমেটকে ফোন করলাম। ও জানতে চাইল, “কী হয়েছে? ঠিক আছিস তুই?” “আমার বাবা মারা গেছে। আর মা আইসিইউতে,” আমি বললাম।
২৬ ফেব্র“য়ারি (বিকাল)
আমার চোখগুলো ততোক্ষণে ফুলে লাল হয়ে গেছে। ফেইসবুকে একটা পোস্ট দিলাম। “আমার বাবা ছিলেন একজন বাঙালি লেখক, বিজ্ঞান আর নাস্তিক্যবাদ নিয়ে লেখার জন্য তিনি পরিচিত ছিলেন। বইমেলায় বইয়ের প্রচারের জন্য গত সপ্তাহে বাংলাদেশে যান আমার বাবা আর মা। ১৫ ঘণ্টা আগে ইসলামী উগ্রবাদীরা আমার বাবাকে কুপিয়ে মেরেছে। আমার মাও আহত, উনি এখনো হাসপাতালে। আমার বাবার মৃত্যুর খবর এখন বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর শিরোনাম। “আমার জন্য না, এই কথাগুলো আমি বাবার জন্য লিখছি। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর ভালোর জন্যই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রয়োজন। “আমার মায়ের সঙ্গে উনার প্রথম ডেটের সময় আমার বয়স ছয় বছর। পরের ১২টি বছরে উনি হয়ে উঠেছিলেন আমার বন্ধু, আমার হিরো, আমার সবচেয়ে ভরসার জায়গা, আমার নাচের সঙ্গী এবং আমার বাবা। “উনি কখনো আমাকে শাসন করেননি; উনি আমাকে শিখিয়েছেন- জানতে হবে, হতে হবে সাহসী, নির্ভীক। “আমি ক্ষোভ থেকে এসব বলছি ভাবলে ভুল হবে। পৃথিবীর ভালোর জন্য লড়াই থামানোর মতো কিছু এখনো ঘটেনি। গভীর মামতায় বাবা আমাকে যা শিখিয়ে গেছেন, তা আমি ধারণ করে যাব। “তোমাকে ভালোবাসি বাবা; যা কিছু আমাকে দিয়েছ, তার সবকিছুর জন্য ভালোবাসি।”
শব্দকে খুন করা যায় না
সেদিন এই শব্দগুলো মানুষ ফেইসবুকে দেখেছিল। কিন্তু তারা দেখেনি যে আমাকে ঘুমানোর জন্য প্রতি রাতে ওষুধ খেতে হয়েছে, যাতে রক্তের মধ্যে পড়ে থাকা বাবার সেই ছবি আমাকে স্বপ্নে দেখতে না হয়। কেউ দেখেনি কতোটা উদ্বিগ্ন ছিলাম মাকে নিয়ে। ভয় হচ্ছিল, হয়তো তাকে আর দেখতে পাব না। যদি পাইও, মা হয়তো আর আগের মানুষটা থাকবে না। আমি হয়তো তার যতœও ঠিকমতো নিতে পারব না। মানুষ জানে না, আমি তখন সারাক্ষণ বাংলাদেশের টেলিভিশনের খবর দেখছিলাম; দিনের প্রতিটা ঘণ্টা। আমি দেখছিলাম, বাবার ছবির পোস্টার নিয়ে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করছে, হত্যার বিচার চাইছে।
কেউ দেখেনি, একটা মেয়ে কেমন করে নির্বাক হয়ে গেল।
৩ মার্চ
মা যেদিন আমেরিকায় ফিরলেন, আমি তাকে চিনতে পারিনি। তার কামানো মাথা দেখে আমার মনে সেইসব দিনের কথা মনে পড়ল, যখন তার থাইরয়েড ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছিল। সেইসব দিনের মতোই আমার বুক খালি হয়ে গেল। রাত ১০টায় আমি বিমানবন্দরে মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একদল ডাক্তার, এফবি আই এজেন্ট আর নিরাপত্তাকর্মী তাকে ঘিরে ছিল। যে লোকটা হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে আসছিল, মা রসিকতা করে তাকে কী যেন বললেন! আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। আমার নানা কাঁদছিলেন। মায়ের কামানো মাথায় ব্যান্ডেজের আশপাশে বার বার হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। ক্লিনিকের ডাক্তাররা ব্যান্ডেজ খোলার পর আমি মায়ের মাথার সেলাইগুলে দেখলাম। মাথায় চারবার কোপ দিয়েছিল ওরা। কিন্তু কোনোটাই গভীরে যেতে পরেনি। তবে এক হাতের বুড়ো আঙুল কাটা পড়েছিল। ক্ষতগুলো দেখতে দেখতে আমার চোখ আঁধার হয়ে এলো। একটা চেয়ারে বসে পড়লাম; রাতটা সেখানেই কাটলো। আমি ঘুমিয়ে পড়েছি মনে হওয়ার পর একসময় মা ফোঁপাতে শুরু করল। আমি পেছন থেকে জড়িয়ে মায়ের হাত ধরে থাকলাম, যতক্ষণ না শান্ত হয়। এই কৌশলটা আমার নানী তার মায়ের কাছে শিখেছিলেন। নানী শিখিয়েছিলেন আমার মাকে, আর মা আমাকে।
২২ মার্চ
আমি আবার ক্যাম্পাসে ফিরলাম, একা। আমাকে বলা হলো, যারা আমার বাবাকে মেরেছে, তারা আমার মাকে, আমাকেও টার্গেট করতে পারে। মা বলে দিল, কোথাও একা যাওয়া চলবে না, রাতে বের হওয়া বন্ধ। এফবি আইয়ের একজন এজেন্টের সঙ্গে আমার কথা হলো। সে জানালো, আমার ভয়ের খুব বেশি কারণ সম্ভবত নেই। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি খুব বেশি বদলালো না।
৩ মে
আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা একটা ভিডিও প্রকাশ করেছে। ইসলামের নামে অভিজিৎ রায়কে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়েছে সেখানে।
২৬ মে
দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর একটা সেমিস্টার শেষ করে আমি জর্জিয়ায়, বাড়িতে এলাম। অদ্ভুত লাগছিল আমার। বাড়ির যে দিকে তাকাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল বাবাকে দেখতে পাব। মনে হচ্ছিল বাবা হয়তো স্টাডিতে বসে টাইপ করছে, হয়তো শোবার ঘরে কাত হয়ে কিছু পড়ছে। ওই হামলার পর তিন মাস কেটে গেছে। মেঝেতে শুয়ে শুয়ে কাঁদছিলাম আমি। কিছুই আমার কাছে বাস্তব মনে হচ্ছিল না। ব্যালকনিতে গিয়ে মনে হলো ঝাঁপ দিই। আমার বন্ধু বুঝিয়ে আমাকে ফিরিয়ে আনলো।
সেপ্টেম্বর
আমার বাবা যেখানে জীবনের বেশিরভাগ সময় বিজ্ঞান আর ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে লেখাপড়া করে কাটিয়েছেন, আমার মায়ের মূল আগ্রহের বিষয় ছিল রাজনীতি আর ইতিহাস, নারীবাদ আর বিশ্ব সংস্কৃতি। একটি ক্রেডিট ব্যুরোর সিনিয়র ডিরেক্টরের পদে ছিলেন মা। চাকরি ছেড়ে কিছুদিনের জন্য ছুটিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি শিওর?” মা হাসতে হাসতে বললেন, “কি জানিৃ “আজ আমার মনে হয়, তোর বাবা নিজের আদর্শের জন্য জীবন দিতে পেরেছেন, আমি নিজের আদর্শের জন্য অন্তত বাঁচার চেষ্টা করতে পারি।” সপ্তাহখানেক পর মা আমেরিকার বাইরে গেলেন। ইউরোপ ঘুরে ঘুরে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করলেন। বাংলাদেশে আর যে অ্যাক্টিভিস্টরা আছে, তাদের বের করে আনতে কাজ শুরু করলেন তিনি; যাতে বাবার মতো একই ভাগ্য তাদের না হয়। তখনো নিজের বিষয়গুলো গুছিয়ে উঠতে পারেননি, অথচ অন্যদের সাহায্য করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন মা।
আজ
মৃত্যু যতো নির্মমই হোক, আমার ধারণা, অন্য কোনোভাবে বেঁচে থাকতে চাইতেন না আমার বাবা। নিজের বিশ্বাসের জন্য প্রাণ দিয়ে তিনি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গেছেন। বিশ্ব সেই বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকে খুন হতে দেখেছে, যে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে পরিচালিত হয় বলে দাবি করা হয়। আমি জানি, আল কায়েদা, আইএস এবং আর যারা ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রচার করে, তারা এখনো তৎপর। তারপরও নিজের গল্প লিখে, তা শেয়ার করে আমি আমার ভূমিকা রাখলাম। আমি এবং আমার মতো অনেকে মিলে, ধীরে ধীরে, ভেবে চিন্তে এবং নিশ্চিতভাবে- সেইসব আদর্শকে দুর্বল করে তুলব, যারা আমাদের ধ্বংস করতে চায়।