খোলা বাজার২৪, সোমবার, ১৪ মার্চ ২০১৬ : এক বছর বা এক দশক নয়; পুরো ৪২ বছর পর মায়ের দেখা পেলেন এক মেয়ে। নাম, এলিজাবেথ পূরভি জোরেনডাল। তাঁর জন্ম ভারতের একটি পরিবারে। তবে নিয়তির ফেরে ছয় মাসেরও কম বয়সে ১৯৭৩ সালে ঠাঁই হয় এক অনাথ আশ্রমে। বয়স যখন আড়াই বছর, তখন এক সুইডিশ দম্পতি তাঁকে সেই অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নেন। নতুন পরিবারে ভালোই কেটেছে দিনগুলো। তবুও নিজের মা আর পরিবারের জন্য মনের কোণে কোথায় যেন একটা হাহাকার ছিল তাঁর। সে দুঃখ ঘোচাতে তিনি মাকে খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেন, আর সফলও হন।
দীর্ঘ সময় পর মা-মেয়ের এই সাক্ষাতের কথা ওঠে এসেছে বিবিসির প্রতিবেদনে। এ ঘটনাকে এলিজাবেথ বলেছেন, ‘এটা অলৌকিক ঘটনার চেয়ে কম কিছু নয়।’
নিজের জীবনের গল্প বলতে গিয়ে এলিজাবেথ বলেন, ‘২১ বছর বয়সে আমার মায়ের বিয়ে হয়। বাবা কৃষক ছিলেন। তিন বছর সংসার করেছেন। একদিন আমার বাবা কারও সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি এসে আত্মহত্যা করেন। আমার মা তাঁর বাবা-মায়ের কাছে চলে যান। তাঁরা চাইছিলেন, মেয়ে আবার বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করুক। কিন্তু তাঁরা জানতেন না, আমার মা অন্তঃসত্ত্বা। এমনকি বিষয়টি আমার মা নিজেও প্রথম দিকে টের পাননি। মায়ের পরিবার যখন বুঝল, তখন তাঁকে পুনের (মহারাষ্ট্র রাজ্য) একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গেল। সেখানে আমার জন্ম, ১৯৭৩ সালে। ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে দেওয়া হলো। এরও বছর দুয়েক পরে এক সুইডিশ দম্পতি আমাকে দত্তক নিয়ে যায়।’
এরপর এলিজাবেথ বলতে থাকলেন, ‘আমি ভারতে থাকা আমার মায়ের কথা ভাবতাম। কে তিনি? কেমন তিনি? কেন তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন? আমার মনে হলো, তাঁকে আমার খুঁজে বের করা দরকার। আমি তো তাঁর জীবনের একটি অংশ।’ তাঁর নতুন বাবা-মা তাঁর এই চাওয়াকে সমর্থন করলেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৯৮ সাল থেকে আমি আমার মাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা শুরু করলাম। প্রায় দুই দশকের মাথায় মহারাষ্ট্রের ছোট্ট এক গ্রামে আমি তাঁর সন্ধান পেলাম, দত্তকের কাগজপত্রে উল্লেখ থাকা মা আর নানার নাম থেকে।’
গত সেপ্টেম্বরে এলিজাবেথ মায়ের সঙ্গে দেখা করতে ভারতের মহারাষ্ট্রের ছোট্ট ওই গ্রামে চলে আসেন। জানতে পারেন, তাঁর মায়ের দ্বিতীয় সংসারে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে। সেই ছেলে আর ছেলের বউয়ের সঙ্গেই তিনি এখন থাকেন। সেই সন্তানদের কাছে মা প্রথম বিয়ে বা মেয়ের বিষয়ে কিছু বলেননি। আকস্মিক এমন সাক্ষাতে প্রথমে মা-মেয়ে দুজনেই নীরব থাকেন। তারপর দুজনই কাঁদতে শুরু করেন।
মায়ের সঙ্গে আরও প্রাণ খুলে কথা বলার জন্য এলিজাবেথ তাঁকে হোটেলে নিয়ে যান। ট্যাক্সিতে করে যাওয়ার সেই সময়টার বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘আমরা পরস্পরের হাত ধরে ছিলাম। টানা দুই ঘণ্টা এভাবে গেলাম, গন্তব্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত। মা বললেন, তিনি আমাকে ছাড়তে চান না। তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে যেতে যান। কারণ, তিনি জানেন না যে আমি সুইডেনে থাকি। আর সেটা কত দূরের দেশ। তবে মা বারবার বলছিলেন, তিনি কখনো ভাবেননি আমাকে আবার দেখতে পাবেন।’
এভাবে কয়েক দিনে মা-মেয়ে পরস্পরের বেশ কাছে চলে আসেন। অবশেষে চলে আসে বিদায়ের দিন। কষ্টের সেই মুহূর্ত সম্পর্কে এলিজাবেথ বলছিলেন, ‘আমাদের শেষ দেখার দিন, আমি তাঁকে ছাড়তে চাচ্ছিলাম না। আমি কাঁদতে শুরু করলাম। তিনি আমার পাশে এসে বসলেন। তাঁর চোখ দিয়েও অঝোরে কান্না ঝরল। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তিনি আমাকে বললেন, কাঁদে না আমার বাচ্চা। আমি তখন বুঝলাম, তিনি আমাকে কতটা ভালোবাসেন!’