Fri. May 2nd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

1kখোলা বাজার২৪, শনিবার, ২৬ মার্চ ২০১৬:স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ওপর ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র তকমা লাগানো পশ্চিমা বিশ্ব এখন ৪৬ বছর পর এ দেশকে ‘সফলতার উদাহরণ’ হিসেবে চিহ্নিত করছে। বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় সাফল্যের সঙ্গে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এমডিজি পূরণের পর থেকেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র।
এরই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই উন্নয়ন-সহযোগী সংস্থা ইউএনডিপি এবং ইউএসএইডের সর্বশেষ বাংলাদেশ বিষয়ক পৃথক দুটি মূল্যায়ন প্রতিবেদনের অভিন্ন শিরোনাম ছিল- ‘বাংলাদেশ, এ সাকসেস স্টোরি’।
এবার বাংলাদেশকে ‘একটি সাফল্যের কাহিনী’ উল্লেখ করে ইউরোপ বলছে, বাংলাদেশ সব প্রচলিত ধারণা বা মিথ ভেঙে দিয়ে অনুকরণীয় ভূমিকায় এসেছে। গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মিথের সঙ্গে যে বাংলাদেশের বর্তমান চিত্রের ন্যূনতম মিল নেই সেটিই ঘোষিত হয়েছে ইউরোপের বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর সম্মিলিত এক প্রতিবেদনে।
জানা যায়, কার্যকর মুক্তবাণিজ্য ও টেকসই সাপ্লাই চেইন তৈরির লক্ষ্য নিয়ে তিন দশক ধরে কাজ করছে ইউরোপের বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বৃহত্তম জোট ফরেন ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন বা এফটিএ। বৈশ্বিক বাণিজ্যের বৃহৎ অংশের সরাসরি নিয়ন্ত্রক এখন এফটিএর সঙ্গে থাকা ১৭০০-এর বেশি বৃহৎ ব্র্যান্ড, আমদানিকারক, বিক্রেতা ও জাতীয় সংস্থা। এফটিএ তাদের মূল ফোকাসে বাংলাদেশ-সংশ্লিষ্ট সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
এফটিএ ফোকাস : ইজ বাংলাদেশ এ সাকসেস কেস’ শিরোনামে গত বছরের শেষার্ধে প্রস্তুত হওয়া এ প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যকে ‘অবিস্মরণীয়’ বলা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রচলিত মিথ বা ধারণা কীভাবে ভেঙে দিয়েছে এর উদাহরণস্বরূপ প্রধান তিনটি মিথ চিহ্নিত করা হয়েছে।
এফটিএর প্রতিবেদন বলছে, এত দিন ধারণা ছিল বাংলাদেশ দারিদ্র্যের কশাঘাতে পিষ্ট। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হাত ধরেই মানবিক উন্নয়ন করেছে। ১৯৯২ সালে থাকা ৫৭ শতাংশ দারিদ্র্যের হার ২০১৪ সালে এসে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে কমিয়ে ২৫ শতাংশে আনতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে মানুষের চাহিদা, সাক্ষরতা ও খাদ্য গ্রহণের সক্ষমতাও বেড়েছে দ্রুতগতিতে।
প্রতিবেদনে ‘স্বল্পসংখ্যক ব্যবসায়ীর লাভের প্রবৃদ্ধিই বেশি’ এমন ধারণাকে দ্বিতীয় মিথ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা বোঝাতে প্রতিবেদনে আয় বণ্টনের সর্বজনগৃহীত সূচক গিনি ইন্ডেক্সের কথা উল্লেখ করে দেখানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের চেয়েও বাংলাদেশে আয়বৈষম্য কম। গিনি ইন্ডেক্সের পয়েন্ট যদি ‘০’ হয় তাহলে আয়ের সত্যিকার সমতা। আর পয়েন্ট ‘১০০’ হলে সত্যিকার বৈষম্য ধরা হয়ে থাকে। এখানে বাংলাদেশের পয়েন্ট হলো ৩২.১। অথচ চীনের পয়েন্ট ৪২.১ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পয়েন্ট ৪১.১। প্রতিবেদনে ‘রাষ্ট্র ও অর্থনীতির জন্য চাপ জনসংখ্যার আধিক্য’কে তৃতীয় মিথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ধারণাকে বাংলাদেশ ভুল প্রমাণ করেছে উল্লেখ করে এফটিএ বলেছে, বেশি বেশি কাজের সুযোগ তৈরি করে যে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা যায় তা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া ১৯৮০ সালে যেখানে নারীপ্রতি জন্মের হার ছিল ৬, সেটিকেও অত্যন্ত কার্যকরভাবে কমিয়ে এনে ২০১৪ সালে ২.২-এ এনেছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদনে ‘আপনি জানেন কি’ শিরোনামে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে থাকবে। চীন ও নাইজেরিয়ার পরই হবে বাংলাদেশের অবস্থান। জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ সেই স্বল্পসংখ্যক দেশগুলোর একটি, যারা জাতিসংঘের সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) প্রায় সবই পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সেনাসদস্য জাতিসংঘে পাঠানোর কৃতিত্বও বাংলাদেশের। বাংলাদেশ সম্পর্কে মূল্যায়ন অংশে এফটিএর মহাপরিচালক ক্রিস্টিয়ান ইউয়ার্ট বলেছেন, ‘অবিস্মরণীয় উন্নয়নের মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়গুলো অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যেই দেশটি ইঙ্গিত দিয়েছে, লক্ষ্যপূরণে অনেক দূর পথ হাঁটবে। এই পথপরিক্রমায় আন্তর্জাতিক বিশ্ব ও অন্যদের বাংলাদেশের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।’
‘দারিদ্র্য দূরীকরণে চ্যাম্পিয়ন’ : সুইজারল্যান্ডের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনে এসডিসির মাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে সিরিজ গবেষণা করেছেন খ্যাতিমান গবেষক ইয়োরস হেইরলি। সিরিজ গবেষণার ওপর লেখা ‘মাই লাস্ট ট্রিপ’ শীর্ষক গ্রন্থে দারিদ্র্য দূরীকরণে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বর্তমান অবস্থায় আসা বাংলাদেশ যে কোনো অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের কাছে বিস্ময়।’ হেইরলি তার গবেষণায় প্রচলিত বিভিন্ন পদক্ষেপের বাইরে ১৯৮৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেড় মিলিয়ন পানির পাম্প বিতরণের উৎসব, ক্ষুদ্রঋণ প্রথার ব্যাপক সম্প্রসারণ, ব্যক্তিগত নার্সারি ও পুনর্বনায়ন আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বলে উল্লেখ করেছেন। সেই সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ বছর আগেই পুরো জনগোষ্ঠীকে স্যানিটেশনের আওতায় আনার সাফল্য বিশ্বকে বাংলাদেশের জাত চিনিয়েছে বলে সেই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
‘আরও সাফল্যের গল্প বলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ : স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পোশাক রপ্তানি খাতে বাংলাদেশের সাফল্য ইতিমধ্যে বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। পাঁচ বছরের কমবয়সীদের জীবন রক্ষা, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, টিকাদান কর্মসূচি, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের সাফল্যের কাহিনী উল্লেখযোগ্য। নারীর ক্ষমতায়নের দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেলের স্থানে পৌঁছে গেছে। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে। এত সব কিছুর পরও ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা গত সপ্তাহে তার টুইটার অ্যাকাউন্টে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে ছবি আপলোড করে বলেছেন, ‘আরও সাফল্যের গল্প বলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।’
সামনে ছয় চ্যালেঞ্জ : আকর্ষণীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশের সামনে কমপক্ষে ছয়টি চ্যালেঞ্জ আছে বলে চিহ্নিত করেছে এফটিএ। চ্যালেঞ্জগুলো হলো—রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শ্রমমান, পরিবেশ, কর্মস্থলের নিরাপত্তা, প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন ও দুর্নীতি। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বারবার রাজনীতির উত্তাপ শুধু স্থিতিশীলতাই নষ্ট করছে না, বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল করার মাধ্যমে গণতন্ত্রের ক্ষতিসাধন করছে। কর্মপরিবেশের ওপর বিশেষ নজর দেওয়ার কথা উল্লেখ করে শ্রমিকদের জন্য মানসম্পন্ন ইথিক্যাল সাপ্লাই চেইন ও নিরাপদ ফ্যাক্টরি স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের ১৪০-এর ঘরে অবস্থানকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এফটিএ বলেছে, প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন ও উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নতুন করে শিল্পনীতি গ্রহণ করলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার আরও বাড়তে পারে।