Fri. May 2nd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

2kখোলা বাজার২৪ সোমবার, ২৮ মার্চ ২০১৬: গুরুতর আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলেন দুই মন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং আ ক ম মোজাম্মেল হক। দেশের সর্বোচ্চ আদালত গতকাল রোববার তাঁদের ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দিয়েছেন।
সাজা হওয়ার পর খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক মন্ত্রিসভায় থাকতে পারেন কি না, তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। আইনজীবীদের একটি বড় অংশই মনে করে, সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকলেও নৈতিকতার প্রশ্নে দুই মন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত।
আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত দুই মন্ত্রীকে সাত দিনের মধ্যে দণ্ডের অর্থ পরিশোধ না করলে এক সপ্তাহ করে জেল খাটতে হবে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের আট সদস্যের বেঞ্চ গতকাল সকালে এই আদেশ দেন।
এর আগে ২০ মার্চ এ দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা রুলের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেছিলেন, দুই মন্ত্রী সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। তাঁদের আইনজীবীদের কাছে প্রধান বিচারপতি জানতে চেয়েছিলেন, সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে তা ভঙ্গের পরিণতি কী হবে? তবে গতকাল সংক্ষিপ্ত আদেশে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেননি আদালত।
৫ মার্চ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় খাদ্যমন্ত্রী একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির আদেশ পাওয়া মীর কাসেম আলীর আপিল মামলা পুনঃশুনানির দাবি জানিয়েছিলেন। ওই শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে অংশ না নেওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি। একই অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে বেশ কিছু মন্তব্য করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। এরপর ৮ মার্চ তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল দেন আপিল বিভাগ।
শুনানি ও আদেশ: গতকাল সকাল সাড়ে নয়টার দিকে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের আট সদস্যের বেঞ্চের কার্যক্রম শুরু হয়। এই বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মো. নিজামুল হক। এ সময় আদালতকক্ষে দুই মন্ত্রী হাজির ছিলেন।
শুনানিতে কামরুল ইসলামের আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, কামরুল ইসলাম নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি ভবিষ্যতে আর কখনো এ ধরনের বক্তব্য দেবেন না বলে অঙ্গীকার করেছেন। তিনি সম্পূর্ণভাবে সর্বোচ্চ আদালতের ক্ষমার জন্য নিজেকে সমর্পণ করেছেন।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেলকে বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা বলেন, ‘বিলিয়া মিলনায়তনের আলোচনা সভা (৫ মার্চের গোলটেবিল) নিয়ে জনকণ্ঠ-এর প্রতিবেদনটি পড়েছেন?’ মাহবুবে আলম বলেন, ‘পড়া হয়নি।’ তখন বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা জনকণ্ঠ-এর প্রতিবেদনটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে দিলে তিনি সেটি আদালতে হুবহু পড়ে শোনান। ওই প্রতিবেদনে দুই মন্ত্রী ছাড়াও বিচার বিভাগ নিয়ে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী, জনকণ্ঠ-এর নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য রয়েছে।
প্রায় দুই শতাধিক আইনজীবী ও অর্ধশতাধিক সাংবাদিকে পরিপূর্ণ আদালতকক্ষে পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে প্রতিবেদনটি পড়া শেষ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল। এরপর প্রধান বিচারপতি বলেন, স্বদেশ রায় একজন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী চার-পাঁচ বছর ধরে রায় দিচ্ছেন না। এ দুজন বিতর্কিত ব্যক্তির সঙ্গে এক মঞ্চে কেন সাংবিধানিক পদধারী দুজন মন্ত্রী বক্তব্য দিতে গেলেন? স্বাধীনতার পর থেকে তিনজন অ্যাটর্নি জেনারেল সততার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁরা হলেন আমিনুল হক, মাহমুদুল ইসলাম ও মাহবুবে আলম। মন্ত্রীরা তাঁদের বক্তব্যে মাহবুবে আলমকে কালিমা দিতে ছাড় দেননি।
এই পর্যায়ে মোজাম্মেল হকের আইনজীবী রফিক-উল হক বলেন, ‘আমি তো নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছি।’ বাসেত মজুমদার আবারও কামরুল ইসলামের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন। বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা বলেন, মন্ত্রীরা যেসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন, তা মানুষের জানা দরকার। এ জন্যই জনকণ্ঠ-এর প্রতিবেদনটি পড়ে শোনাতে বলা হয়েছে।
শুনানি শেষে আদালত ১০ মিনিটের বিরতিতে যান। সাড়ে ১০টার দিকে আদালতের কার্যক্রম আবার শুরু হলে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা সব বিচারক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করেছি। জনকণ্ঠ-এর প্রতিবেদনে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের সবাইকে আমরা ইচ্ছা করে প্রসিকিউট (বিচার করা) করিনি। আমরা আদালত অবমাননা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চাই না। শুধু দুজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রসিডিংস ড্র (কার্যক্রম নেওয়া) করেছি সারা জাতিকে একটি বার্তা দেওয়ার জন্য। ভবিষ্যতে যেন কেউ এ ধরনের অবমাননার পুনরাবৃত্তি না করেন। তারা দেখুক আমরা কত কঠোর হতে পারি।’
এরপর আদেশে আপিল বিভাগ বলেন, ‘দুই মন্ত্রী নিঃশর্ত ক্ষমা ও অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে যে আবেদন করেছেন, তা গ্রহণ করতে আমরা অপারগ। আবেদনকারীরা মন্ত্রী, সাংবিধানিক পদধারী। তাঁরা সংবিধান রক্ষার শপথবদ্ধ। প্রধান বিচারপতি ও সর্বোচ্চ আদালতকে অবমাননা করে তাঁরা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আমাদের কাছে উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে হয়েছে। তাঁদের বক্তব্য বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপের শামিল এবং বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণœ করেছে। যদি তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে যেকোনো ব্যক্তি বিচার বিভাগ সম্পর্কে একই রকম অবমাননাকর বক্তব্য দেবেন। এ জন্য তাঁদের গুরুতর আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হলো। তবে প্রথম সুযোগেই তাঁরা নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ায় সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে উদারতা দেখানো হয়েছে।’ এরপর আদালত সাজা ঘোষণা করেন।
সর্বোচ্চ আদালত দণ্ডের টাকা ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল ও লিভার ফাউন্ডেশন বাংলাদেশকে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন।
আদেশের পর খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক পরে বলেন, আদালত যে রায় দিয়েছেন, সেটা তাঁদের এখতিয়ার। তিনি এই রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করবেন।
নৈতিকতার প্রশ্ন: সাজাপ্রাপ্ত দুই মন্ত্রী স্বপদে থাকতে পারবেন কি না, আদেশের পর সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজ কার্যালয়ে বলেন, ‘এ বিষয়ে এই মুহূর্তে আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়। সংবিধানে এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলা আছে বলে আমার মনে হয় না। তবে এর সঙ্গে নৈতিকতার ব্যাপারটি জড়িত। মন্ত্রিসভা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ অবশ্য মনে করেন, আদালত অবমাননায় সাজাপ্রাপ্ত দুই মন্ত্রীর পদে থাকতে কোনো বাধা নেই। তিনি বলেন, সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে মন্ত্রিত্ব যাওয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করে। আর ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংসদ সদস্য তাঁর সদস্যপদ হারাবেন যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। দুই মন্ত্রীর বিষয়ে ৬৬ অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য নয়। কারণ, তাঁরা নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে দণ্ডিত হননি। এটা নৈতিকতার বিষয় নয়, আদালত অবমাননা।
তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের একটি বড় অংশ মনে করে, নৈতিকতার প্রশ্নে সাজাপ্রাপ্ত দুই মন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, এ বিষয়ে আইন নিশ্চুপ, কোনো আইনে এ-সংক্রান্ত বিধান নেই। তবে এটা নীতি ও মূল্যবোধের ব্যাপার। দুই মন্ত্রী দণ্ডিত অপরাধী। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের দৃষ্টিতে এমন ব্যক্তিরা মন্ত্রিসভায় থাকতে পারেন না। তাই প্রত্যাশা হবে, সোমবারের নিয়মিত মন্ত্রিসভার বৈঠকের আগেই তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে সরে দাঁড়াবেন।
একই মত দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। তিনি বলেন, আদালত অবমাননা করে মন্ত্রীরা স্পষ্টতই সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংবিধান রক্ষার শপথ ভঙ্গ করেছেন। তাই তাঁদের পদে থাকার কোনো অধিকার নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমপক্ষে দুজন আওয়ামীপন্থী আইনজীবী বলেন, নৈতিক কারণে কামরুল ইসলাম ও মোজাম্মেল হকের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়া উচিত। তাঁদের মতে, আদালতে সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির মন্ত্রিসভায় থাকা ভালো দেখায় না। নিজ দলের সহকর্মী হওয়ায় মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলতে তাঁরা রাজি হননি।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বিদায়ী সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও সম্পাদক এম মাহবুব উদ্দিন খোকন অবিলম্বে দুই মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। গতকাল সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘যদি তাঁরা পদত্যাগ না করেন, আশা করব প্রধানমন্ত্রী তাঁদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করবেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একজন সাজাপ্রাপ্ত লোক মন্ত্রিসভায় থাকতে পারেন না, এ জন্য কোনো আইনের প্রয়োজন হয় না।
দুই মন্ত্রীর থাকা না-থাকা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমি রায় না দেখব, ততক্ষণ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না।