খোলা বাজার২৪, বুধবার, ৩০ মার্চ ২০১৬ : ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভোটে অনিয়ম রোধে ব্যর্থতার জন্য সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার ও পাঁচ ওসিকে শাসিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
বুধবার ব্যর্থতা নিয়ে তাদের ব্যাখ্যায় ‘অসন্তোষ’ প্রকাশ করে দু’সপ্তাহের মধ্যে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে জানাতেও বলেছে নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটি।
যত দ্রুত সম্ভব আসামিদের গ্রেপ্তার, তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগপত্র দাখিলের নির্দেশ দিয়ে ইসি সতর্ক করে বলেছে, ফের ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন ইসির অধীনে অনিয়ম রোধে কঠোর নির্দেশনার পরও যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার এটাই প্রথম ঘটনা।
বুধবার শুনানিতে ইসির প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে ‘নীরব ভূমিকা’ পালন করেন তারা।
সাতক্ষীরার পাঁচ উপজেলায় ভোটের আগে ব্যালট পেপারে সিল মারাসহ অনিয়ম রোধে ব্যর্থতার বিষয়ে এদিন এসপি চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির ও পাঁচ ওসি মোস্তাফিজুর রহমান, এনামুল হক, শেখ মাসুদ করিম, এমদাদুল হক শেখ ও তরিকুল ইসলামের ব্যাখ্যা শোনে ইসি।
বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত ইসির সম্মেলন কক্ষে সিইসি ও কমিশনারদের মুখোমুখি হন তারা।
শুনানি শেষে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, “পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে সার্বিক বিষয়ে ব্যাখ্যা শুনেছি। এ নিয়ে আমাদের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি দুটোই জানিয়েছি। তাদের ভুল ধরিয়ে দিয়েছি, তারা এখন তা বুঝতে পেরেছে। কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে অঙ্গীকার করেছে তারা।”
‘মুখে কুলুপ’
ইসির কাছে কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন- জানতে চেয়ে এসপির কাছ থেকে সন্তোষজনক কোনো উত্তর মেলেনি; ওসিদের দেখাই মেলেনি। এসপিকে মনে হচ্ছিল যেন ‘মুখে কুলুপ’ দিয়েছেন তিনি।
বেলা ২টায় ইসির সম্মেলন কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসপি মঞ্জুর বলেন, “আমার বক্তব্য সুস্পষ্ট- আমার কোনো বক্তব্য নেই। আমার কোনো মন্তব্য নেই।”
নবম ইউপি ভোটের প্রথম ধাপে গত ২২ মার্চ সারাদেশে ৭১২টি ইউপিতে ভোট হয়। আগের রাতে সাতক্ষীরার তালা, সদর উপজেলা, শ্যামনগর, কলারোয়া ও দেবহাটা উপজেলার ১৪টি কেন্দ্রে অনিয়মের ঘটনা ঘটে।
সে রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ঢুকানোর অভিযোগে ভোটের সকালে তালার কুমিরার তিনটি, সদরের আলীপুরের চারটি, শ্যামনগরের কৈখালীর তিনটি, কলারোয়ার কুশডাঙ্গার দুটি ও কেরালকাতার একটি এবং দেবহাটার পারুলিয়া ইউপির একটি কেন্দ্রে ভোট বন্ধ করে ইসি।
ইউপিতে দলীয় প্রতীকে প্রথম এই ভোটে গোলযোগ-অনিয়মের কারণে ১৩ জেলার মোট ৬৫টি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করা হয়। সাতক্ষীরায় অনিয়ম ও পরবর্তী কার্যক্রমের বিষয়ে ব্যাখ্যার জন্য ডাকা হয় তাদের।
শুনানিতে উপস্থিত ইসির একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, এই প্রথম ইসি কোনো কর্মকর্তাকে তলব করে ব্যাখ্যা চেয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা তেমন সদুত্তর দিতে পারেননি। ইসি বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
এক কর্মকর্তা বলেন, “আমার ৩০ বছরেরও বেশি চাকরি জীবনে এমন দৃশ্য দেখিনি। অবশেষে ইসি ঘুরে দাঁড়াল বলে মনে হল। ভোট নিয়ে একের পর এক অভিযোগের তীরে বিদ্ধ ইসি পুলিশ কর্মকর্তাদের ডেকে এনে কঠোর অবস্থান নিল।”
সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, ওসিদের ‘পলায়ন’
বেলা ১১টায় ইসিতে হাজির হন সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার এবং সদর, তালার পাটকেলঘাটা, শ্যামনগর, কলারোয়া ও দেবহাটার ওসি। এসময় ইসির সম্মেলন কক্ষে সিইসি, তিন নির্বাচন কমিশনার, সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তবে শুনানি সামনে রেখে শেরেবাংলা নগরস্থ ইসি কার্যালয়ের একাংশে সাংবাদিক প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
পরিকল্পনা কমিশন চত্ত্বরে ইসির দুটি ব্লকের মধ্যে যে অংশে সিইসি ও সম্মেলন কক্ষ রয়েছে, তার প্রবেশ পথেই গণমাধ্যমকর্মীদের আটকে দেওয়া হয়।
এই পথের দায়িত্বে থাকা ইসির নিরাপত্তাকর্মী নজরুল ইসলাম বলেন, “এখন সাংবাদিক প্রবেশ করবে না। এ বিষয়ে জনসংযোগ শাখা থেকে নির্দেশনা রয়েছে।”
ইসির তৃতীয় তলায় তিন ঘণ্টাব্যাপী শুনানি শেষে সাংবাদিকরা পুলিশ কর্মকর্তাদের অপেক্ষায় ছিলেন তাদের বক্তব্য নেওয়ার জন্য।
পাঁচ ওসি একবার নিচে এসে বেরুনোর পথে গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে উপরে চলে যান। পরে সাংবাদিকদের ফাঁকি দিয়ে আরেক পথ দিয়ে অনেকটা লুকিয়ে ইসি ছাড়েন তারা।
সবশেষে এসপিকে পাওয়া গেলেও তাদের অবস্থানের বিষয়ে সাংবাদিকদের কিছু জানাতে রাজি হননি তিনি।
বিমর্ষ মুখে ঘুরে ফিরে বিভিন্ন প্রশ্নে তিনি একটা কথাই তিনি বলেছেন, “আমার বক্তব্য সুস্পষ্ট- আমার কোনো বক্তব্য নেই। আমার কোনো মন্তব্য নেই।”
তার কাছে সাংবাদিকরা বার বার জানতে চাইছিলেন কমিশন যে অভিযোগ এনেছে আপনারা স্বীকার করে নিচ্ছেন? অনিয়মের পরও আপনার কোনো নির্দেশনা ছিল কি? ইসির কাছে কী ব্যাখ্যা দিলেন?
প্রশ্নের ‘তোপে’ পুলিশ কর্মকর্তারা
শুনানিতে উপস্থিত একজন উপ-সচিব জানান, শুনানিতে প্রথম পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে সুষ্পষ্ট কয়েকটি বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে ওসিরা অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করেন; পরে এসপিও যোগ দেন।
এসময় কমিশনার আবদুল মোবারক আইনি বিষয়গুলো তুলে ধরে পুলিশ কর্মকর্তাদের দুর্বলতা ধরিয়ে দেন। তার প্রশ্নের মুখে ‘কিছুটা বেকায়দায়’ পড়েন পুলিশ কর্মকর্তারা।
সিইসি ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেছেন, “নতুন কোনো অজুহাত শুনতে চাই না। এখনও সময় রয়েছে। আসামি গ্রেপ্তার করে, মামলা দিয়ে ও আরও ব্যবস্থা নিয়ে ইসিকে দেখাতে হবে। নতুবা পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।”
এসময় পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি তুলে ধরার পাশাপাশি পুরো পরিস্থিতি বুঝতে প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের কাছেও ব্যাখ্যা চাওয়ার অনুরোধ করেন।
কেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেননি, আসামিরা প্রকাশ্যে কেন ঘুরে বেড়াচ্ছে? পুলিশের পোশাক পরে কীভাবে রাতে ব্যালটে সিল মেরেছে? অর্থ নেওয়ার অভিযোগ ও ওসি সিল মারার নেতৃত্ব দিয়েছে? এসব বিষয়ে সরাসরি প্রশ্ন করা হয় পুলিশ কর্মকর্তাদের।
‘ভুল বুঝতে পেরেছে পুলিশরা’
শুনানি শেষে নিজ কার্যালয়ে কমিশনার শাহনেওয়াজ বলেন, “কোথায় কোথায় তাদের ভুল আছে, তা তারা বুঝতে পেরেছে। সে অনুযায়ী কাজ করবে- এই অঙ্গীকার করেই তারা গেছে।”
পুলিশ যা বলেছে তাতে কমিশন কতটুকু সন্তুষ্ট জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তাদের ব্যাখ্যা শুনেছি। সন্তুষ্টি এবং অসন্তুষ্টি দুটোই জানিয়েছি তাদেরকে। ভবিষ্যতে যেন না হয়, সে বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছি। তারাও অঙ্গীকার করেছে, এই ধরনের ভুলগুলো হবে না।”
আসামি গ্রেপ্তারে সময় দেওয়া হয়েছে কি না- জানতে চাইলে শাহনেওয়াজ বলেন, “আইনে কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করা নেই। দুই সপ্তাহের মধ্যেই যথাসম্ভব ব্যবস্থা নিতে বলেছি।