Thu. May 1st, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

3খোলা বাজার২৪, শুক্রবার, ১ এপ্রিল ২০১৬: ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে দেশের সাত উপজেলায় হানাহানির ঘটনায় এক শিশু, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রসহ আটজন নিহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, প্রার্থীসহ আহত হয়েছে কয়েক শ মানুষ।
ভোটকেন্দ্র দখল ও জাল ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে গুলি, বোমা বিস্ফোরণ ও সংঘর্ষে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অনেক স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে গুলি ছুড়তে হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ৩১টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করেছে।
নিহতদের মধ্যে রয়েছে ঢাকার কেরানীগঞ্জে এক শিশু, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে দুজন, মাদারীপুরে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে এক নারী এবং নাটোরের লালপুর, যশোর সদর ও জামালপুরের মেলান্দহে একজন করে। অনিয়ম, হানাহানি ও জবরদস্তির প্রতিবাদে অনেক ইউপিতে সরকারি দল ছাড়া অন্য প্রার্থীরা ভোট বর্জন করেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় ধাপে ৪৭ জেলার ৬৩৯টি ইউপির নির্বাচনে ৬ হাজার ২০৫টি কেন্দ্রের ৩২ হাজার ২১টি বুথে ভোট গ্রহণ হয়।
এর আগে ২২ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের তুলনায় গতকালের নির্বাচনে সহিংসতা, জবরদস্তি ও প্রাণহানি কম হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণের দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে ১১ জন নিহত ও সহস্রাধিক আহত হয়েছিলেন। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২। এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে ইউপি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন হচ্ছে। মোট ছয় ধাপে সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন হবে। শেষ ধাপের ভোট গ্রহণ হবে ৪ জুন।
কেরানীগঞ্জের হযরতপুর ইউনিয়নের মধুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সকাল ১০টার দিকে রানা মোল্লা নামের এক ব্যক্তি ২৫-৩০ জন লোক নিয়ে কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল মারার চেষ্টা চালান। রানা আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আনোয়ার হোসেন আয়নালের লোক হিসেবে পরিচিত। তাঁদের তাণ্ডবে ওই কেন্দ্রের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা গুলি ছুড়লে নয় বছরের শিশু শুভ কাজী মারা যায়। মধুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শুভ তার মায়ের সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে এসেছিল। তার বাবা হালিম কাজী পেশায় অটোরিকশাচালক। বাড়ি হযরতপুরের ঢালিকান্দি গ্রামে। ওই ঘটনায় হাজেরা বেগম নামের এক বৃদ্ধাও গুলিবিদ্ধ হন। তিনিও ভোট দিতে এসেছিলেন। তাঁকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চরকুতুব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সদস্য প্রার্থীদের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে মো. রনি (২৭), মাসুম মিয়া (২৫) ও অজ্ঞাত এক যুবক (২৩) গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাঁদের স্থানীয় ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।
.মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার বাগুটিয়া ইউনিয়নের বারুলিয়া গ্রামে গতকাল রাতে সংঘর্ষে এক নারী নিহত হয়েছেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে পরাজিত সদস্য প্রার্থী তোতা মিয়া ও শিপন শেখের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে নমেছা বেগম (৫০) নামের ওই নারী নিহত হন। তিনি ওই গ্রামের ইমাম শেখের স্ত্রী। এ ছাড়া হরিরামপুরের বয়ড়া ইউনিয়নের উজান বয়ড়া সরকারি বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর লোকজন কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করলে গুলি চালায় পুলিশ। এতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সৈয়দ হাসান ইমামের ছোট ভাই সৈয়দ হুমায়ুন মাথায় গুলিবিদ্ধ হন।
নাটোরের লালপুর উপজেলার আড়বাব ইউপির রঘুনাথপুর গ্রামে গতকাল সকালে নৌকা ও ধানের শীষের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষের সময় নৌকার সমর্থকেরা জনৈক বিপ্লবসহ (৪৫) কয়েকজনকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় বিপ্লবকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় বিপ্লব মারা যান। লালপুরে এ ছাড়াও বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
যশোর সদর উপজেলার চাঁচরা ইউনিয়নের ৬৫ নম্বর চাঁচড়া ভাতুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে হামলা ও সংঘর্ষে আবদুস সাত্তার নামের একজন ফেরিওয়ালা নিহত হয়েছেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ প্রসঙ্গে যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পদপ্রার্থী বিল্লাল ও লাল নামে আওয়ামী লীগের দুই কর্মীর নেতৃত্বে ভোটকেন্দ্রে বোমা হামলা চালানো হয়েছে। এতে ফেরিওয়ালা আবদুস সাত্তার নিহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলি চালিয়েছে।
জামালপুরের মেলান্দহের একটি কেন্দ্রের বাইরে দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ বাধলে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে এক তরুণ মারা যান।
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ভোট গণনা শুরু হলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এতে দুজন নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামের অন্যান্য কেন্দ্রে অনিয়ম ও জবরদস্তির প্রতিবাদে সেখানকার ৩০টি ইউপিতে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির প্রার্থীরা।
মাদারীপুরের ধুরাইলে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া ও গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিহত হয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যায় দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া হয়। এ সময় গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র সুজন মৃধা নিহত হন। পরিবারের অভিযোগ, পুলিশের গুলিতে সুজনের মৃত্যু হয়েছে।
মোতালেব মৃধা বলেন, ‘নির্বাচনে আমি বিজয়ী হই। আমার ভোট কারচুপি করে আয়ুবালীর সমর্থকেরা জয় ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তারা ব্যালট পেপার ছিনতাই করে। পুলিশ আমার সমর্থকদের ওপর হামলা চালায়। পুলিশের গুলিতে আমার নাতি মারা গেছে।’
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার সরোয়ার হোসেন বলেন, এ ঘটনায় পুলিশ কোনো গুলি ছোড়েনি। কীভাবে ছেলেটি মারা গেছে, তা তদন্ত না করে বলা যাবে না।
শেরপুরের শ্রীবরদীতে নির্বাচনী সামগ্রী নিয়ে ফেরার পথে রাত নয়টার দিকে একদল লোক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়ি ভাঙচুর করেছে। কাকিলাকুড়া ইউনিয়নের খামারদহেরপাড়া গ্রামে ওই ঘটনায় ইউএনও হাবিবা শারমীন ও তাঁর গাড়িচালক পিন্টু মিয়া আহত হয়েছেন।
দক্ষিণের দ্বীপ জেলা ভোলার ১২টি ইউপিতে গতকাল ভোট গ্রহণ করা হয়। কয়েকটি ইউপির ১০টি কেন্দ্রে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে এনটিভির একজন সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নে পুলিশের গুলিতে ছয়জনসহ বিভিন্ন স্থানে মোট আহত হয়েছেন প্রায় ৩৫ জন।
মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর ও সিরাজদিখানের বিভিন্ন কেন্দ্রে সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। জেলার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে ২০ থেকে ২৫টি গুলি ছুড়তে হয়েছে।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন ইউপিতে কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই, ব্যালট বাক্স ভাঙচুর ও হানাহানির ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফাঁকা গুলি ছুড়েছে। জেলার জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনির হোসেন নয়টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করার কথা জানান।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর লোকজনের ওপর প্রতিপক্ষের হামলায় ১০ জন আহত হয়েছেন। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কাওয়াখোলা ইউনিয়নের বড় কয়রা কমিউনিটি ভোটকেন্দ্রে ব্যালট ছিনতাইয়ের অভিযোগে সংঘর্ষ শুরু হলে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে ওই কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলায় নির্বাচনী সংঘর্ষে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ ২৫ জন আহত হয়েছেন। নলকায় ব্যাপক জাল ভোটের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার খুরমা দক্ষিণ ইউপির ধনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই প্রতিপক্ষের সংঘর্ষে দুজন গুলিবিদ্ধসহ সাতজন আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ শটগানের গুলি ছুড়েছে। বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার আটটি ইউপির অধিকাংশ কেন্দ্রেই ব্যাপক জাল ভোট পড়েছে।
গতকালের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের পর ডেমক্রেসিওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভোট ব্যবস্থাপনায় অনেক ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো, বিলম্বে ভোট শুরু করা, কেন্দ্রের আশপাশে প্রচার ও তাতে শিশুদের অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে।
ব্রতীর প্রাথমিক প্রতিবেদনে দ্বিতীয় ধাপের ভোট গ্রহণেও অনিয়ম, সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।