খোলা বাজার২৪, শনিবার, ২ এপ্রিল ২০১৬: কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী ও নাট্যশিল্পী সোহাগী জাহান তনু হত্যার পর ১১ দিন পার হলেও এ-সংক্রান্ত মামলার তদন্তে দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই। এ ঘটনায় গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়নি। আর এ প্রেক্ষাপটে সবাইকে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে তনু হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে ঢাকা ও কুমিল্লায় আয়োজিত সমাবেশ থেকে। এদিকে তনু হত্যার ক্লু বের করতে তাঁর নিহত হওয়ার সময় নিশ্চিত হতে চাইছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। যে বাসায় তিনি প্রাইভেট পড়াতেন সেই বাসা থেকে বের হওয়ার পরপরই নিহত হয়ে থাকলে হত্যার মোটিভ এক রকম; আর যদি প্রাইভেট পড়ানোর অন্তত দুই ঘণ্টা পর খুন হয়ে থাকেন তাহলে মোটিভ আরেক রকম হতে পারে। আর তাই এখন ওই সময় নিশ্চিত হতে কাজ করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তনুর লাশ যেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে সেখানেই তিনি খুন হয়েছেন এমন তথ্যে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত হতে পারছেন না।
এর বিপরীতে বরং ধারণা করা হচ্ছে, কোনো বাসায় তনু খুন হয়ে থাকতে পারেন। এদিকে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তে তদন্ত কর্মকর্তারা কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর পেতে কিছু আলামত ভিসেরা রিপোর্টের জন্য চট্টগ্রাম সিআইডিতে পাঠিয়েছেন। ময়নাতদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. কামদাপ্রসাদ সাহা জানান, রিপোর্ট পেতে ১০-১২ দিন সময় লাগবে।
মামলার তদন্তের অগ্রগতি জানতে সিআইডির ইন্সপেক্টর গাজী মোহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তনুর ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে তনুর ছয়টি ডায়েরি, কলম, ওষুধের খালি প্যাকেট, ওড়না, কাটা চুল, স্যান্ডেল, পরনের কাপড়চোপড়।
ঢাকায় নাগরিক সমাবেশ : তনু হত্যার বিচার ও ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবিতে গতকাল বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে নাগরিক সমাবেশ করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। সমাবেশের পর চার দফা দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি শুরু করা হয়েছে। দেশব্যাপী এক কোটি মানুষের গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে জাতীয় সংসদে জমা দেবে সংগঠনটি। দাবিগুলো হলো অবিলম্বে তনুর ধর্ষক ও হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, হাইকোর্ট প্রণীত যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা বাস্তবায়ন, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং সব নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সমাবেশে মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার বলেন, তনু হত্যার ১১ দিন পার হলেও খুনিদের গ্রেপ্তার কিংবা চিহ্নিত করতে কোনো অগ্রগতি নেই। দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থা ঘটনাটি তদন্ত করলেও এখনো কোনো কূল-কিনারা পায়নি। সঠিক তথ্যানুসন্ধানে অগ্রগতি না হলেও হয়েছে ধামাচাপায়। নানাভাবে জড়িতদের আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিকেল ৩টায় ওই নাগরিক সমাবেশ শুরু হয়।
এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ছাত্রসংগঠনসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করে। সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল শাহবাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ঘুরে আবার শাহবাগে গিয়ে শেষ হয়। সমাবেশে বক্তব্য দেন সংগীতশিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবু, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. মুস্তাক হোসেন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জিলানী শুভ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক নাসিরউদ্দিন প্রিন্স প্রমুখ।
ইমরান বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনার মতো এ ঘটনায়ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে আশ্বস্ত করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ফল আসছে না। ক্রমাগত খুন, ধর্ষণ, বিচারহীনতার কারণে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, এর জন্য কি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল! সকলের সমান অধিকারের একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্য আমাদের পূর্বপুরুষরা যুদ্ধ করেছিলেন।’ তিনি বলেন, প্রশাসনের সব মহলের ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় এ কথা পরিষ্কার যে ধর্ষকরা শক্তিশালী কেউ। তনুর পরিবারকেও কথা বলতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। হেনস্থা করা হচ্ছে। আজকে যাঁরা ভাবমূর্তির কথা ভাবছেন, তাঁদের উচিত অপরাধীকে দ্রুত খুঁজে বের করে বিচার করা। খুনিদের বিচারে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের দাঁতভাঙা জবাব দিতে হবে।’ কুমিল্লায় আন্দোলন অব্যাহত : তনু হত্যার বিচারের দাবিতে কুমিল্লায় গতকালও আন্দোলন হয়েছে। মহানগরীর কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে প্রতিবাদ সভা করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মী। বিকেল ৪টায় কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) কুমিল্লা শাখা ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) কুমিল্লা শাখা।
এতে বক্তারা বলেন, তনু হত্যার ১১ দিন অতিবাহিত হলেও প্রশাসন এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। হত্যাকাণ্ডের কোনো ক্লু সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেনি। বক্তারা বলেন, তনু এখন শুধু একটি পরিবারের সন্তান নয়, তনু এখন নারী নির্যাতন ও নারী হত্যার ঘটনায় প্রতিবাদের বাতিঘর। নির্মম এ হত্যাকাণ্ডকে যারা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন কিংবা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছেন তাঁরা গণ-আন্দোলনের মুখে পার পেতে পারেন না, তনুর হত্যাকারীর বিচারের পাশাপাশি তাঁদেরও কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। বক্তারা তনু হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে সবাইকে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
সিপিবি-বাসদের প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য দেন সিপিবি কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাহ আলম, কুমিল্লা শাখার সভাপতি এ বি এম আবুল বাশার, সাধারণ সম্পাদক পরেশ কর, বাসদ চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক মইনউদ্দিন মহিন, ছাত্রফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি আল কাদেরী জয়, ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সদস্য মেহেদী হাসান নোমেন, ছাত্র ইউনিয়নের জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক আবু সাঈদ প্রমুখ। প্রতিবাদ সভার আগে কুমিল্লা টাউন হলের সামনে থেকে সিপিবি ও বাসদের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি মহানগরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। বিকেল ৫টায় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা তনু হত্যার বিচারের দাবিতে পূবালী চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রতিবাদ সভা করে। এতে বক্তব্য দেন গণজাগরণ মঞ্চ কুমিল্লার সংগঠক খায়রুল এনাম রায়হানসহ ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীদের স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে কান্দিরপাড় এলাকা।