খোলা বাজার২৪, রোববার, ৩ এপ্রিল ২০১৬: অবশেষে এক অসহায়ের সহায় হয়েছে। দীর্ঘ ১৯ বছর বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেওয়া একটি মেয়ে স্থায়ী ঠিকানা পেয়েছে। নাম-পরিচয় ও ঠিকানাবিহীন মেয়েটিকে উৎসবের আমেজে বিয়ে দিয়ে স্বামীর হাতে তুলে দিয়েছে সরকার। গত শুক্রবার আফরিদা খাতুন নামে মেয়েটিকে বিয়ে দেওয়া হয় সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার তেতুলিয়া গ্রামের শহীদুল ইসলাম সরদারের ছেলে মুদি দোকানি নাফিউর আসাদ রুবেলের সঙ্গে।
জেলা প্রশাসক খলিলুর রহমানসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে দুই লাখ টাকা দেনমোহরে কাবিন লেখা হয়। অনুষ্ঠানে মেয়ের উকিল পিতা ছিলেন পুনর্বাসন কেন্দ্রের হাউজ প্যারেন্ট মো. কামরুজামান ঠাকুর। বিয়ে পড়ান মওলানা আব্দুর কাইয়ুম। বিয়ের অনুষ্ঠানে উপহার সামগ্রীর কমতি রাখেনি প্রশাসন। রঙিন টিভি, ফ্রিজ, ডিনারসেট, সেলাই মেশিন, মুদি দোকানের মালামালসহ অন্যান্য গৃহস্থালি পণ্য। আফরিদা খাতুনের বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে শেখ রাসেল দুঃস্থ শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রঙিন পতাকা ও লাল-নীল-বেগুনি রংয়ের কাগজের নিশান টাঙিয়ে সাজানো হয়। বৃহস্পতিবার গায়েহলুদ ও শুক্রবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিনভর চলে নানা অনুষ্ঠানিকতা। পুনর্বাসন কেন্দ্রটির ৩০০ নিবাসী আনন্দে মেতে ছিল। সাউন্ড বক্স বাজিয়ে নেচে-গেয়ে আনন্দ-উল্লাস করে তারা। বিকেলে নতুন দম্পতিকে স্থানীয় রীতিতে দুধ-ভাত খাইয়ে সব অনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বিদায় জানানো হয়।
আফরিদার জীবনের ১৯টি বছর কেটেছে বিভিন্ন বেবি হোম, শিশু সদন ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে। একবছর বয়সে ঠাঁই হয়েছিল রাজশাহীর বেবি হোমে। ছয় বছর বয়সে তাকে পাঠানো হয় নওগাঁ শিশু পরিবারে। সেখান থেকে যশোর শিশু পরিবার হয়ে টুঙ্গিপাড়া শেখ রাসেল দুঃস্থ শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ঠাঁই হয়। মেয়েটি নিজের বাবা বা মায়ের নাম জানেন না। দেখতে দেখতে বছর পেরিয়ে শিশু থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনে পা দেন তিনি। তাকে সঠিক জায়গায় পুনর্বাসনের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর ও টুঙ্গিপাড়া উপজেলা প্রশাসন উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসেবে গতকাল শুক্রবার অন্য দশটি বিয়ের মতো সব অনুষ্ঠানিকতা করেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রায় ৫০০ লোক খাওয়ানো হয়। খাদ্যতালিকায় ছিল কাচ্চি বিরিয়ানি, মুরগির রোস্ট, ডিম ভোনা, দই, মিষ্টি ও কোমল পানীয়।
অনুষ্ঠানে গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. খলিলুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোমিনুর রহমান, টুঙ্গিপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফিউল্লাহ, সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক সমীর মল্লিক, ওই প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালক ফারহানা নাসরিনসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও আশাশুনি উপজেলার কাদাকাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দ্বিপংকর সরকার, বরের চাচা আব্দুস সালাম সরদারসহ ৮০ জন বরযাত্রী। বিয়ের পিঁড়িতে বসা আফরিদা তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন হোমে বড় হয়েছি। আমার বাবা-মা নেই- তা কখনও বুঝতে পারিনি। সব সময় হোমের বোনদের সঙ্গে লেখাপড়া ও খেলাধুলা করে বড় হয়েছি। শিক্ষকরা ছিলেন আমার বাবা-মার মতো। আজ আমাকে যেভাবে স্বামীর বাড়ি পাঠালেন, তা আমার জন্য বিরাট পাওয়া। কারণ ধনী লোকের মেয়ে বা ছেলের বিয়েতে এত আয়োজন এত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকেন না। যা আমার ক্ষেত্রে হয়েছে। আমি দাম্পত্য জীবনে সবার দোয়া ও আশীর্বাদ কামনা করি। যাতে শ্বশুর-শাশুড়িকে বাবা-মার আসনে বসিয়ে পূর্বের অভাব পূরণ করতে পারি। সর্বোপরি সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।
আফরিদার স্বামী নাফিউর আসাদ রুবেল জানান, তার স্ত্রীকে নিয়ে আগামী দিনে একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখছি। আমি মা-বাবার একমাত্র ছেলে। বাবা প্রবাসে। মেয়েটির না ছিল কোনো পরিচয়, না ছিল কোনো সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। তার কষ্টের কথা ভেবে মা-বাবাকে রাজি করিয়ে বিয়ে করতে পেরে নিজেকে ধন্য বা গর্বিত মনে করছি। আমার কারণে আফরিদার একটি নতুন ঠিকানা হলো, আমি তাকে সুখে রাখবো, এবং সুন্দর জীবনযাপন করব। শেখ রাসেল দুঃস্থ প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক ফারহানা নাসরিন বলেন, “১৮ বছর পূর্ণ হওয়ায় প্রতিষ্ঠানে নিয়মানুয়ায়ী মেয়েটির আর এখানে রাখার সুযোগ ছিল না। তাকে আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছি। বাবা-মা বা আত্মীয়-স্বজনের পরিচয় জানি না। এদিকে, তার বিয়ের বয়সও হয়েছে। তাই তাঁকে পাত্রস্থ করার মাধ্যমে পুনর্বাসন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তার স্বামীকে পুনর্বাসন করার জন্যও সহযোগিতা করা হয়েছে। এতে নতুন দম্পতি সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবে।
গোপালগঞ্জ জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক সমীর মল্লিক বলেন, “আট-দশটা মেয়ের যেমন বিয়ে হয়, আমরা তেমন অনুষ্ঠানিকতা করে তার বিয়ে দিয়েছি। আমরা আনুষ্ঠানিকতার কমতি রাখিনি যাতে সে মনে না করে তার মা-বাবা নেই। আমরা তার অভিভাবকের অভাব পূরণ করার চেষ্টা করেছি। টুঙ্গিপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শফিউল্লাহ বলেছেন, “টুঙ্গিপাড়া উপজেলা প্রশাসন ও সমাজসেবা অধিদপ্তর মেয়েটির একটি নতুন ঠিকানা দিতে পেরে আনন্দিত। এই নতুন দম্পতি যাতে সুখে থাকতে পারে তার জন্য আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। আগামীতেও আমরা খবর রাখবো ও সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করব।